জামায়াত কি চলমান রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে

দেশের রাজনীতিতে এখন টালমাটাল পরিস্থিতি চলছে। বলা যায়, একধরনের উত্তুঙ্গ অবস্থায় আছে। বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা প্রতিদিনই দাবি আদায়ের জন্য কমবেশি কর্মসূচি পালন করছে। আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীরাও সরব। পাল্টা কর্মসূচিও তারা ঘোষণা করছে। বিএনপি কর্মসূচি দিলেই আওয়ামী লীগ একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ডান, বাম, মধ্যপন্থী ও ইসলামপন্থী—সবাই এখন কর্মসূচির ভেতরেই আছে। কিন্তু রাজনীতি মাঠে নেই জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতকে কোনো পন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা মুশকিল।

এমনিতে সাধারণ মানুষ মনে করে, জামায়াতে ইসলামী ইসলামপন্থী দল। কিন্তু জামায়াতের অনেকেই এটা স্বীকার করতে চান না। তাঁরা বলেন, জামায়াত ইসলামপন্থী নয়, ইসলামি দল। ইসলামপন্থী ও ইসলামি ধারার মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার নয়। তবে একটা পার্থক্য হচ্ছে, ইসলামপন্থীরা কঠোরভাবে শরিয়াহ আইন অনুসরণ করলেও ইসলামি দলগুলো শরিয়াহ আইন ততটা বাস্তবায়নের পক্ষে নয়। যদিও এটা জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কথা নয়; তবে তৃণমূলে অনেকেই এমনটা বলে থাকেন যে জামায়াত ইসলামপন্থী নয়, বরং ইসলামি দল।

দীর্ঘদিন ইসলামপন্থী বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে আসা দলটির পন্থা নিয়ে তৃণমূলের নিশ্চিত না হওয়া থেকে বোঝা যায়, এক অনিশ্চিত সময় পার করছে জামায়াতে ইসলামী। বলা যায়, অনেকটা পরিচয়সংকটে ভুগছে জামায়াতে ইসলামী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কট্টর পন্থা না মডারেট—কোন ধারার রাজনীতিতে অগ্রসর হতে হবে, তা নিয়ে জামায়াতের মধ্যে মতভেদ ও দ্বন্দ্ব আছে।

এক দশক ধরেই প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই জামায়াতে ইসলামী। দলটির শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর দলটি ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এর পর থেকে রাজনীতিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে চলমান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে জামায়াতের কোনো ধরনের প্রকাশ্য সম্পৃক্ততা নেই।

দেখা যাচ্ছে এককভাবে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ জামায়াত পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে না থেকে দেশের রাজনীতি থেকে যেন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জামায়াত ক্রমে যেন নিঃসঙ্গ এক দলে পরিণত হয়েছে। জামায়াতের আশপাশে এখন কেউ নেই। রাগ, গোস্‌সা, অভিমান বা কৌশল, যা-ই হোক না কেন, জামায়াত চলমান রাজনীতি থেকে সাংগঠনিকভাবে পুরোপুরি না হলেও অনেকটা ছিটকে পড়েছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

যদিও গত জুন মাসে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছিল জামায়াত। সমাবেশের আগে পুলিশকে ফুল দিয়ে তারা আলোচিত- সমালোচিত হয়েছে। পুলিশের হাতে দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার দলটির অনেকেই পুলিশকে ফুল দেওয়া পছন্দ করেননি। তবে এই সমাবেশ করে দলটির আত্মবিশ্বাস এতটাই ওপরে উঠেছিল যে তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ সরকারবিরোধী আন্দোলন করবে না বলে ঘোষণা দেয়। জামায়াত বলেছিল, তারা আর বিএনপির সঙ্গে নেই। নিজেরাই আলাদাভাবে সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করবে। সেই অনুযায়ী কর্মসূচিও ঘোষণা করে জামায়াত।

কিন্তু জামায়াতের পুলিশকে ফুল দেওয়া বা বিএনপির বাইরে গিয়ে পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণার কৌশল কাজে এসেছে বলে মনে হয় না। কারণ ঢাকার পর আর কোথাও জামায়াত সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে সমাবেশ বা সভা করার জন্য পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু ফুল দেওয়াতেও পুলিশের মন গলেনি; মানে জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পায়নি। সর্বশেষ ঢাকাতেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে পায়নি।

তবে গত মাসের শেষ দিন বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে জামায়াত পুলিশের অনুমতি ছাড়াই বিক্ষোভ মিছিল করেছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া মিছিল করা সম্ভব। কারণ হুট করে নেতা-কর্মীদের নিয়ে মিছিল করে আড়ালে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু পুলিশ না চাইলে সমাবেশ করা কঠিন। আর জামায়াত এখন এমন অবস্থায় নেই যে পুলিশের অনুমতি ব্যতিরেকেই সমাবেশ করে ফেলবে।

যদিও গত জুন মাসে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় জামায়াত

জামায়াত সম্ভবত ভুল রাজনীতির ফাঁদে পড়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই জামায়াত রাজনীতিতে সময়কে ধারণ করতে পারেনি। আমাদের রাজনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এসে বারবার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ইতিহাস থেকে ছিটকে গেছে জামায়াত ।  ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতের অবস্থান সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল না। এ কারণে জনমানুষের কাছে জামায়াত যতটা না ইসলামপন্থী বা ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচিত, তার চেয়ে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে।
জামায়াত মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা বিভিন্ন দেশে এর শাখা সংগঠনগুলোর ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বলে মনে করে। কিন্তু আরবের ইসলামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী ও উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতি করেছে সব সময়। আর আমাদের এখানে জামায়াত বরাবরই জনমতকে গুরুত্ব না দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদী শক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াত এখনো সেই ভুলের রাজনীতি থেকে বের হতে পারেনি। তাই এবারও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পক্ষে তাদের অবস্থানটি তারা পরিষ্কার করতে পারছে না। যদিও জামায়াত বারবার বলছে, তারা এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে যাবে না এবং সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা আঁতাতও হয়নি; তবে গুঞ্জন রয়েছে, সরকারের সঙ্গে একধরনের সমঝোতার কারণেই জুন মাসে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছিল। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ওই সমাবেশে জামায়াত তাদের দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের নাম ও ছবি ব্যবহার করেনি। যত দূর জানা যায়, দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের নাম উচ্চারণ করা হবে না—এমন শর্তেই জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সমঝোতা হয়েই থাকে, তবে এরপর জামায়াত আর অনুমতি পায়নি কেন? ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেওয়ার অনুমতিটি ছিল সম্ভবত আওয়ামী লীগের রাজনীতির অংশ। কারণ, ওই সমাবেশের অনুমতি ও জামায়াতের ফুল দেওয়ার পরই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এতে করে সরকারবিরোধী শিবিরে জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।

অন্যদিকে, জামায়াত অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ওই সমাবেশের পর। পবিত্র কোরবানির ঈদের ছুটিতে জামায়াতের নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রচার-প্রচারণাও করেছেন দলের নিবন্ধন ও প্রতীক না থাকার পরও। জামায়াত হয়তো আশা করেছিল বা আশ্বাস পেয়েছিল, তাদের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সম্ভবত এ আশাতেই জামায়াত আন্দোলনের ভরা মৌসুমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে। অথচ আগামী নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। আদৌ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে কি না অথবা নির্দলীয় সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ মেনে নেবে কি না, তার সুরাহা হওয়ার আগেই নিবন্ধনবিহীন দলের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার করাকে অতি আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

বিএনপির সঙ্গে যেহেতু জামায়াতের জোট নেই, বিএনপি তাদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণও জানাচ্ছে না এবং বিএনপি তাদের দুঃসময়ে তাদের পাশে ছিল না—এসব যুক্তি তুলে ধরে তারা বিএনপির সঙ্গে আর আন্দোলনে না থাকার কথা বলেছে। অতি আত্মবিশ্বাস থেকেই সম্ভবত তারা এমন একটি অবস্থান নিয়েছে। এখন বিএনপির সঙ্গে না হয় তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, রাজনীতিতে দলগুলোর মধ্যে এমনটা হতেই পারে; কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির সঙ্গে না থাকার কারণ কী?

দেখা যাচ্ছে এককভাবে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ জামায়াত পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে না থেকে দেশের রাজনীতি থেকে যেন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জামায়াত ক্রমে যেন নিঃসঙ্গ এক দলে পরিণত হয়েছে। জামায়াতের আশপাশে এখন কেউ নেই। রাগ, গোস্‌সা, অভিমান বা কৌশল, যা-ই হোক না কেন, জামায়াত চলমান রাজনীতি থেকে সাংগঠনিকভাবে পুরোপুরি না হলেও অনেকটা ছিটকে পড়েছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক