ডিজিটাল ব্যাংক: বিগ ডেটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবধারিত আবির্ভাব

নতুন নতুন ডিজিটাল উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে। প্রযুক্তির সহায়তায় কার্যকরভাবে গ্রাহকদের কাছে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকও পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় অনেকের মনে প্রশ্ন, এত দিন ধরে চলা মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন, এমএফএসগুলোর মাধ্যমে টাকা প্রেরণ, সবই তো ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তাহলে নতুন আসা ডিজিটাল ব্যাংক কী!

আসলে এগুলো হচ্ছে প্রথাগত ব্যাংকের গতানুগতিক সেবার পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমেও কিছু আংশিক সেবা প্রদানের ব্যবস্থামাত্র। প্রথাগত ব্যাংকের বিভিন্ন জায়গায় শাখা আছে, কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকের শাখা থাকে না। বড়জোর একটি সদর দপ্তর থাকতে পারে। ডিজিটাল ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে ঋণ প্রদান, আর্থিক বিবরণী থেকে টাকা জমা করা, সব কার্যক্রমই হবে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়। 

একটা স্কুলের সঙ্গে তুলনা করা যাক। স্কুলের ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। সে স্কুলে কিছু কিছু জিনিস আবার অনলাইনে দেখাও সম্ভব হয়। যেমন নোটিশ, ফলাফল, পরীক্ষার রুটিন, ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে সেটিকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্কুল বলা চলে না। অন্যদিকে খান একাডেমি বা টেন মিনিট স্কুলের কোনো শাখা নেই, ভবন নেই। মূল সেবাসহ সব কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। 

২৪ ঘণ্টা যেকোনো জায়গায় বসে ডিজিটাল স্কুলের সেবা গ্রহণ সম্ভব। কোনো ধরনের ক্যাম্পাস বা ভবন ব্যবস্থাপনার খরচ নেই বলে পরিচালনা ব্যয়ও কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে প্রথাগত স্কুলে যেভাবে পূর্ণমাত্রায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব, ডিজিটাল স্কুলে সেটি সম্ভব নয়। যেমন ল্যাব নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, ইত্যাদি। প্রথাগত ব্যাংক ও ডিজিটাল ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এ রকম তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধা আছে।

প্রচলিত ব্যাংকে ডাকাতি করতে হলে সশরীর ব্যাংকে গিয়ে উপস্থিত হতে হয়। ডিজিটাল ব্যাংকে বোরা বোরা আইল্যান্ড কিংবা মাদাগাস্কারে বসেই ডাকাতি করে ফেলা যায়। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে হওয়া প্রতারণায় এ দেশের নাগরিকেরা যখন কয়েক হাজার কোটি টাকা হারিয়ে ফেলেছে, তখন গ্রাহকদের আস্থা অর্জন এবং কম খরচে মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে ডিজিটাল ব্যাংকের সাফল্য।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমহারে উচ্চারিত আরও দুটি নাম অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং। অনলাইন ব্যাংকিং মূলত ব্যাংকের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিষেবা (ব্যালান্স চেক করা, লগইন করা) গ্রহণ করা আর মোবাইল ব্যাংকিং হলো স্মার্টফোনজাতীয় ডিভাইসে অ্যাপ ব্যবহার করে সমজাতীয় সেবাগুলো গ্রহণ করা। ডিজিটাল ব্যাংকিং মূলত এই ধরনের ব্যাংকিংকে একই সেবার আওতায় নিয়ে আসে (ফোর্বস, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। এফডিআইসি ২০২১ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬৫ বছরের অধিক বয়সীদের মধ্যে যেখানে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ গ্রাহক সশরীর ব্যাংকে উপস্থিত হন, সেখানে ৩৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে সেটি শতকরা ৫ ভাগেরও কম। অর্থাৎ, সুস্পষ্টভাবে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে। 

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে বর্তমান কাগজ-কলম পদ্ধতির ডিজিটাল রূপান্তর ছাড়াও সেসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনতে হবে বিভিন্ন পরিচালনা পদ্ধতির। যেমন গ্রাহকের তথ্য যাচাইয়ের জন্য এখানে ঘণ্টা বা দিনব্যাপী অপেক্ষা করিয়ে রাখার সুযোগ নেই। বলতে গেলে তাৎক্ষণিক যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এই পরিচয় যাচাইয়ের জন্য অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইনফরমেশন সিস্টেমগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারতে হবে। যেটির জন্য আবার প্রয়োজন হতে পারে ব্যাংকিং এপিআই (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস) ব্যবহারের। অর্থাৎ যোগাযোগের প্রক্রিয়াটিও প্রযুক্তিনির্ভর।

এই যে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ, লাখ লাখ মানুষের ডেটা, কোটি কোটি টাকার লেনদেন—এসব চলমান অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনো ট্রানজেকশনের মাধ্যমে জালিয়াতির প্রচেষ্টা হচ্ছে, কোনো ব্যবহারকারীর পরিচয় নকল, কোন ঋণ আবেদন গ্রহণ করা হবে। ঠিক এখানটাতে অবধারিতভাবে চলে আসবে বিগ ডেটা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগুলোর কথা।

সাধারণত চারটি ‘ভি’–সম্পন্ন (আইবিএম, ২০১৯) ডেটাকে বিগ ডেটা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে—বিশাল আকার (ভলিউম), দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ (ভেলোসিটি), বিভিন্ন ধরন (ভ্যারাইটি) এবং গুণমান (ভ্যারাসিটি)। ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার কার্যক্রমে এই চারটি ‘ভি’–ই বিদ্যমান। তার মানে, প্রচলিত ডেটা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি ও সফটওয়্যার দিয়ে এই ডেটা প্রক্রিয়াকরণ করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন হবে বিগ ডেটা বিশ্লেষণের ব্যবস্থা ও প্রস্তুতির।

অপরদিকে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতে থাকা বিশাল সংখ্যক ডিজিটাল লেনদেন বা আবেদন যদি প্রথাগতভাবে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে যাবে। দ্রুততম সময়ে সেবা পাওয়ার প্রত্যাশাতেই গ্রাহকের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে আকৃষ্ট হওয়ার কথা। অতএব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভর করে ডেটা বিশ্লেষণ করে দ্রুততম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটা মেশিনকেই করতে হবে।

কিছু কিছু বিষয় শুরু করতে হয় আগে, কিন্তু এগোতে হবে বুঝেশুনে। প্রযুক্তিকে ধাপে ধাপে, গ্রাহকের বিশ্বস্ততা অর্জন করে, ধীরে ধীরে জীবনব্যবস্থার অংশ করে নিতে হয়। যেটির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকবে ডিজিটাল ব্যাংকিং, সেই ডেটা ও সিস্টেমের সাইবার নিরাপত্তা প্রদান হবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

প্রচলিত ব্যাংকে ডাকাতি করতে হলে সশরীর ব্যাংকে গিয়ে উপস্থিত হতে হয়। ডিজিটাল ব্যাংকে বোরা বোরা আইল্যান্ড কিংবা মাদাগাস্কারে বসেই ডাকাতি করে ফেলা যায়। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে হওয়া প্রতারণায় এ দেশের নাগরিকেরা যখন কয়েক হাজার কোটি টাকা হারিয়ে ফেলেছে, তখন গ্রাহকদের আস্থা অর্জন এবং কম খরচে মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে ডিজিটাল ব্যাংকের সাফল্য।

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। ই–মেইল: bmmainul@du.ac.bd