এক চীন নীতির প্রতি ভারতের বর্তমান অস্পষ্ট অবস্থান তাইওয়ানের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।
এক চীন নীতির প্রতি ভারতের বর্তমান অস্পষ্ট অবস্থান তাইওয়ানের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।

মতামত

ভারত চীনের সঙ্গে নিজস্ব তাইওয়ান কার্ড খেলছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের ১০ দিন পর এবং তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের বড় পরিসরে সামরিক মহড়া শেষে ভারত একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিষয়টা কিছুটা আশ্চর্যজনক। গত ১২ আগস্ট নয়াদিল্লি ‘উত্তেজনা প্রশমন’-এর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এরপর আগস্ট মাসের ২৮ তারিখ নয়াদিল্লি শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত নিজেদের দূতাবাসের মাধ্যমে তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের সামরিকীকরণের জন্য বেইজিংকে দায়ী করে বিবৃতি দেয়।

নয়াদিল্লি সেই বিবৃতিতে ‘এক চীন’ নীতির প্রতি একটা অস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। ১২ বছর ধরে চীনের একটি পদক্ষেপের প্রতিবাদে ভারত প্রকাশ্যে এক চীন নীতিতে সমর্থন দেয় না। এর কারণ হলো, অরুণাচলের একটি সীমান্তপথ দিয়ে ভারতীয় ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসার অনুমোদন দিয়েছে বেইজিং। ওই সীমান্তপথ প্রশাসনিকভাবে ভারত পরিচালনা করলেও চীন সেটিকে দক্ষিণ তিব্বতের বলে দাবি করে।

এক চীন নীতির প্রতি ভারতের বর্তমান অস্পষ্ট অবস্থান তাইওয়ানের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। তাইওয়ান সম্প্রতি ‘নতুন দক্ষিণ বন্ধননীতি’ নামে একটি নীতি নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাইপের সঙ্গে আসিয়ান, দক্ষিণ এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের সম্পর্ক দৃঢ় করা।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত যদি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হতে চায়, তাহলে এক চীন নীতি নিয়ে অস্পষ্ট অবস্থান বদলাতে হবে। বাণিজ্য সহযোগিতা ও জনগণের সঙ্গে জনগণের বন্ধন শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে ভারতকে সুস্পষ্টভাবে তার ইন্দো-মহাসাগরীয় নীতি প্রকাশ করতে হবে। চীনের সঙ্গে ভারতের যে হৃদ্যতা, তা বজায় রেখে তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা সম্ভব নয়। তাইওয়ান ও ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে দুই গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যকার স্বার্থ।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হলে ভারতে তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বিকাশের পথ তৈরি হবে। এ ছাড়া তাইওয়ানে ভারতের অভিবাসী পেশাজীবীদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমানে তাইওয়ানে পাঁচ হাজারের মতো উচ্চশিক্ষিত ভারতীয় বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। ভারত-তাইওয়ান মৈত্রী স্থাপনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক বহুপক্ষীয় কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা বিমসটেকের মতো সংস্থা থাকা সত্ত্বেও ভারত খুব সতর্কভাবে তার ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল বেছে নিয়েছে। বেইজিংয়ের দিক থেকে আসা ভয়ের কারণেই এ কৌশল নিয়েছে দিল্লি।

২০২১ সালে ভুটানের ডোকলাম মালভূমিতে চীন ও ভারত মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর আগে ২০১৮ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম দেশটির ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল কী হবে, সেই রূপরেখা ঠিক করেন। রূপরেখায় ভারত স্পষ্ট করে বলে, চীনকে ঠেকানো ভারতের লক্ষ্য নয়, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপরেখায় আসিয়ানের ভূমিকা হবে কেন্দ্রীয়। রূপরেখায় বিতর্কগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া মুক্তবাণিজ্য এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

এই রূপরেখায় আঞ্চলিক সংযুক্তি কীভাবে আরও গভীর করা যাবে, সেই বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে হলে একটি উন্মুক্ত বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সংযুক্তি প্রয়োজন। ভারতের ‘পূর্বমুখী’ কর্মপন্থা এবং চীনের ‘নতুন দক্ষিণ বন্ধন’ নীতি—এই দুয়ের মধ্যেই দুটি বিষয়ই রয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে ভারতের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর সম্পর্কিত অবস্থান জোরালো হতে থাকে। সে সময় থেকেই দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, দক্ষিণ চীন সাগরকে বিশ্বের সাধারণ জায়গা বলে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সে বছরেই দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে।

ভারত বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এক জোটে কাজ করছে। ২০২০ সালে নরেন্দ্র মোদি ও জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা ‘একটি স্বাধীন ও মুক্ত অর্থনৈতিক রূপরেখা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল স্থিতিশীল সরবরাহব্যবস্থার পূর্বশর্ত’ বলে সম্মত হন।

তাইওয়ানের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধন ভারতের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীতিতে বাড়তি মূল্য যোগ করতে পারে। ডোকলাম উত্তেজনার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে চীনের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে ‘নমনীয়’ পথ বেছে নেওয়া এবং তাইওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানের জনগণ নয়াদিল্লির কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান সমর্থন পাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। যদিও ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে বাণিজ্য সাত গুণ (১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে) বেড়েছে। কিন্তু তাইওয়ানের মোট বাণিজ্যের এটা মাত্র এক শতাংশ। ২০১৬ সালে ভারতে ভ্রমণে আসা তাইওয়ানের পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৫০০। ভারত থেকেও প্রায় একই সংখ্যক পর্যটক ওই বছর তাইওয়ানে ভ্রমণে যান।

অনেকে বলে থাকেন, ভারতের এখন উচিত ২০২১ সালে শুরু করা মুক্তবাণিজ্য-সম্পর্কিত আলোচনাটি শেষ করে তাইওয়ানকে বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এ ছাড়া রাজনীতি, থিঙ্কট্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর করা।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হলে ভারতে তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বিকাশের পথ তৈরি হবে। এ ছাড়া তাইওয়ানে ভারতের অভিবাসী পেশাজীবীদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। বর্তমানে তাইওয়ানে পাঁচ হাজারের মতো উচ্চশিক্ষিত ভারতীয় বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। ভারত-তাইওয়ান মৈত্রী স্থাপনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাইওয়ানে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৫ সালে তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার, ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২২৩। ভারত-তাইওয়ান সংযুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

নারায়াণন গোপালান লক্ষ্মী কানাডার এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের পোস্টগ্র্যাজুয়েট রিসার্চ স্কলার
ইভস টিবারগেইন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে