এবারে কৃষকেরা বেগুন চাষ করে লাভ তো দূরে থাক উৎপাদন খরচ তুলতে পারেনি
এবারে কৃষকেরা বেগুন চাষ করে লাভ তো দূরে থাক উৎপাদন খরচ তুলতে পারেনি

নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিলে কৃষকের লাভ কী?

পশ্চিমের দেশগুলোতে সাধারণত উৎসবের মৌসুমে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমিয়ে দেন। তাতে তাঁদের ক্ষতি হয় না কোনো। কারণ, দাম কমার কারণে বিক্রি বেশি হয়, উৎসবের আমেজটাও ভালো থাকে। আমাদের দেশে এর উল্টোটা ঘটে। এবারের রোজার মাসে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত নাগরিকেরা বেকায়দায় ছিলেন।

ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তাই ১৫ মার্চ তারিখে ২৯টি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মাছ, মাংস, মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, সবজি, বিভিন্ন প্রকার ডাল, এর সবই ছিল এই পণ্য তালিকায়। অধিদপ্তর আশা করছিল এতে করে ভোক্তারা সহনীয় দামে এই সব সামগ্রী কিনতে পারবেন।

অধিদপ্তরের দেওয়া খুচরা মূল্যতালিকায় বেশ রসিকতার উপাদান আছে। এতে আছে মুগ ডাল ১৬৫.৪১ টাকা, খেসারি ৯২.৬১ টাকা, পাঙাশ ১৮০.৮৭ টাকা, কাতলা মাছ ৩৫৩.৫৯ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ২৩.৩৮ টাকা ইত্যাদি। এত সূক্ষ্ম হিসাব কী করে সম্ভব হলো, আর তার প্রয়োগই–বা কী করে সম্ভব, তা ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি বুঝতে অক্ষম। গত ১০ বছর এক টাকার কম মূল্যের কোনো মুদ্রা আমার নজরে আসেনি, আর এক পয়সা, পাঁচ পয়সা তো কবে শেষ দেখেছি, মনেও করতে পারছি না। নির্ধারিত এই দরে অবশ্য বাজারে কেনাবেচা হয়নি। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেই দুদিন পর আশা প্রকাশ করেছেন যে বাজার নিজে থেকেই সংশোধিত হবে।

উচ্চবিত্তদের জন্য দ্রব্যমূল্য সমস্যা নয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের এই সরকারি প্রয়াসের লক্ষ্য মূলত সীমিত আয়ের শহুরে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ। এই দুই শ্রেণির মানুষ বিদ্যমান বাস্তবতায় দ্রব্যমূল্য নিয়ে সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং এদের অসন্তোষ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু গ্রামের যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসব সামগ্রী উৎপন্ন করেন, তাঁদের কণ্ঠ কি প্রতিফলিত হয় কোথাও?

সরকার থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, পুরো প্রক্রিয়ায় সবারই চাওয়া খাদ্যপণ্যের দাম যাতে না বেড়ে যায়। উচ্চ মূল্যে উৎপন্ন ফসলের দাম কম থাকলে কৃষক কী করে টিকে থাকবেন, এ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বা বিশ বছরে চালের দাম কতটা বাড়ল তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা। সে তুলনায় কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কতটা বাড়ল, সে হিসাবটা করেন খুব কম মানুষ। তিনটা উদাহরণ দিই এখানে।

১. ইলা মিত্র, হাজী দানেশ প্রমুখের তেভাগা আন্দোলনের কথা মনে আছে কি? ১৯৪৬-৪৮ সালের এই আন্দোলনের দাবি ছিল ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন কৃষক আর এক ভাগ পাবেন জমির মালিক। এই আন্দোলন সফল হয়নি। এই শতাব্দীর শুরুতেও বর্গা জমির অর্ধেক ফসল পেতেন জমির মালিক। আমার সামান্য দু–তিন বিঘা ধানিজমি আছে গ্রামে। সম্প্রতি তেভাগা ব্যবস্থায়ই এই জমি বর্গা দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। কারণ, ধান উৎপাদনের ব্যয় এত বেড়েছে যে তিন ভাগের এক ভাগ জমির মালিককে দিলেও খরচ গিয়ে কৃষকের খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। চালের দাম বাড়লে খবরের কাগজের পাতায় প্রবল উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়। সে তুলনায় এই দামে কৃষক কী করে চাল উৎপাদন করবেন এবং টিকে থাকার মতো লাভ করবেন, তা নিয়ে কণ্ঠস্বর খুবই ক্ষীণ।

২. আমার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়। এই এলাকা বেগুন এবং অন্যান্য সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। আমরা জানি, রমজান মাসে শহুরে বাঙালির ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে বেগুনি। ফলে রমজানে বেগুনের দাম বেড়ে যায় অনেক। যদিও ঢাকার বাজারের উচ্চ মূল্যের বড় অংশই যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পেটে। তবে এবার ঘটেছে এক অদ্ভুত বিপর্যয়।

১১ মার্চ বারৈচা বাজারে পাইকারি দরে বেগুন বিক্রি হয়েছে এক হাজার টাকা মণ (৪০ নয়, ৪২ কেজিতে মণ)। ঢাকায় সেই বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। এরপর এল ‘কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ’। বেগুনের খুচরা মূল্য নির্ধারিত হলো ৪৯.৭৫ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে বারৈচা বাজারে দাম নেমে এল ৪০০ টাকা মণ, বা ১০ টাকা কেজিতে। এর মাঝে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশি তৎপরতা, ম্যাজিস্ট্রেটদের আনাগোনা। পরের সপ্তাহে বেশির ভাগ পাইকার আর গেলেন না বেগুন কিনতে। দু-একজন যাঁরা গেলেন, তাঁরা দাম হাঁকলেন ১৫০ টাকা মণ। অনন্যোপায় কৃষক এই দামে বিক্রি করে খেত থেকে বেগুন তোলা বন্ধ করে দিলেন। ফলে বেগুন এবং গাছ দুটোই নষ্ট হয়ে গেল। এলাকার বেশির ভাগ বেগুনচাষি খরচ তুলতে পারেননি, লাভ তো দূরের কথা। মধ্যস্বত্বভোগীরা অবশ্য লোকসানে পড়েননি, পথে পথে চাঁদাবাজির রেটও নাকি কমেনি। ঢাকার ভোক্তার জন্য দামটা একপর্যায়ে নেমে এসেছিল ৩৫–৪০ টাকায়।

৩. কৃষকের কাছ থেকে ১০০ টাকায় কেনা তরমুজ বিভিন্ন স্থানে ওজন দরে বিক্রি হচ্ছিল ৮০০ টাকায়। ম্যাজিস্ট্রেটের হস্তক্ষেপে দাম হয়ে গেল অর্ধেক। ইতিমধ্যে উচ্চ মূল্যের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরমুজ বর্জনের আহ্বানে ব্যবসায়ীদের স্টকে থাকা কিছু তরমুজ নষ্টও হলো। কিন্তু মূল ধাক্কাটা গিয়ে পড়ল কৃষকের ঘাড়ে। পাইকারেরা তরমুজ কেনা বন্ধ করায় তাঁদের বিপুল পরিমাণ তরমুজ খেতে নষ্ট হয়ে গেল। একজন পাইকার কেনাবেচা না করলে তাঁর লাভ হবে না ঠিকই, তবে তাঁকে কোনো লোকসানও গুনতে হবে না। কিন্তু যে কৃষক বিপুল অর্থ এবং শ্রম বিনিয়োগ করেছেন তরমুজ সৃষ্টিতে, তাঁর লোকসান পূরণ করবে কে?

পশ্চিমের দেশগুলোতে সরকার সজাগ থাকে যেন কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কমে গিয়ে তাঁকে লোকসানে পড়তে না হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি তো আছেই। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আগস্ট ২০২৩–এর জরিপে বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীন প্রায় ২৪% বা প্রায় ৪ কোটি মানুষ। (ডেইলি স্টার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)। এক কোটির বেশি মানুষ আছেন চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। দুর্ভিক্ষ এড়াতে এবং খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে কৃষককে তাঁর উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে কৃষককে উচিত মূল্য দিয়েও ভোক্তার জন্য সহনীয় মূল্যে পণ্য সরবরাহ সম্ভব, ‘যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ’ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। পাশাপাশি অবশ্য সিন্ডিকেট করে যাঁরা অতিরিক্ত দাম বাড়ান, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিন্ডিকেট কারা করেন, সরকার তা বিলক্ষণ জানে। প্রয়োজন শুধু যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস এবং সদিচ্ছা।

বর্তমান অবস্থায় সীমিত আয়ের নিম্নবিত্ত মানুষ বাজারমূল্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী কিনতে পারছেন না। তাঁদের ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁদের দেয় সুবিধা যেন সরকার–ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা লোপাট করতে না পারেন।

● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব