বিশ্লেষণ

রপ্তানি আয় নিয়ে ‘কেলেঙ্কারি’ ভুল, না ইচ্ছাকৃত

বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের হিসাব মেলে না। বাজারে গেলে সাধারণ মানুষ টের পান প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আসলে কত। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেই তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক আগে থেকেই। সম্প্রতি রপ্তানি আয়ের হিসাব নিয়ে যে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে লিখেছেন শওকত হোসেন

২৫ বছর আগে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান ফ্রেডারিক টেম্পল বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উপাত্তকে অলৌকিক আখ্যা দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালের প্রবল বন্যায় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। তখন বৈদেশিক সাহায্যের জন্য প্যারিসে দাতাদের বৈঠক হতো প্রতিবছরের এপ্রিল মাসে। ১৯৯৯ সালের প্যারিস বৈঠকে জানানো হয়েছিল, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

একই বছরের ২৬ মে অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) চূড়ান্ত করতে যে এনইসি বৈঠক হয়েছিল, সেখানে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশ ধরেই ছাপার কাজ শুরু হয়েছিল। সেই সমীক্ষা ফেরত এনে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করে নতুনভাবে ছাপানো হয়। সরকারের দাবি ছিল, বোরোর উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে, তাই প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে।

এভাবে ধাপে ধাপে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। ৩০ মে ফরেন চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে ফ্রেডারিক টেম্পল বলেছিলেন, ‘৫ দশমিক ২ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের দাবি অলৌকিক (তিনি মিরাক্যুলাস শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন)। এতে সরকারের অর্থনৈতিক এজেন্ডার তুলনায় রাজনৈতিক এজেন্ডাই বেশি দেখা যাচ্ছে। বোরোর উৎপাদন ভালো হলেও প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের কিছু বেশি হবে।’

বলাই বাহুল্য, সরকার বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তার এ বক্তব্যে মোটেই খুশি হয়নি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এর তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তলব করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে ফ্রেডারিক টেম্পলের মন্তব্যকে বলা হয়েছিল ‘অনাহূত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য’।

জিডিপি বাড়ানোর সে কাজ করেছিল পরিকল্পনা ও কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, মোট ফসল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ টন। অথচ আগের তথ্য ছিল, প্রকৃত উৎপাদন হবে ২ কোটি ৩ লাখ টন। বিষয়টি নিয়ে তখন জাতীয় সংসদও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। ১৪ জুন বিরোধী দলের সদস্যরা পরিসংখ্যান বিকৃতির জন্য পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে অভিযুক্ত করেছিলেন। এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয় পুরো বাজেট অধিবেশনে।

তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ১১ জুলাই ব্যাংকিং খাতের নৈতিকতা নিয়ে বিআইবিএমের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ, না ৫ শতাংশ ছিল, তা নিয়ে জাতীয় সংসদে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল এবং বিনা কারণে অতীতকে টেনে এনে যেভাবে পরস্পরকে গালিগালাজ করা হলো, তাতে দুনিয়ার কাছে আমরা জাতি হিসেবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি।’

২.

পরিসংখ্যান নিয়ে দেশে বিতর্ক নতুন নয়। এমনকি আইয়ুব খানের তথাকথিত ‘উন্নয়ন দশকের’ সময়েও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ ছিল। দেশেও অনেকবারই জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা দেখা গেছে। তবে গত এক দশকে এই বিতর্ক বেশি দেখা গেছে। যেমন কৃষি খাত ঋণাত্মক ও প্রবাসী আয় কমে গেলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। আবার পরের অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশের কিছু বেশি, তারপরও প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর পরের অর্থবছরে আবারও প্রবৃদ্ধি বাড়লে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খুব বেশি না বাড়লেও কেবল ভোগ ব্যয়ের ওপর ভর করে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হবে না।’

বেতন কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের কারণেও একবার প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো হয়েছিল। তবে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বড় বিতর্কটি হয়েছিল করোনা মহামারির প্রথম বছরে। ২০২০ সালে পাঁচ মাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একপ্রকার বন্ধই ছিল। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল সামান্য বা ঋণাত্মক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এমনকি তখন বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়িয়ে দেখানো হয়।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা সে সময় সরকারের পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, ‘প্রবৃদ্ধি হারের তথ্য রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি এখন একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।’ একই অভিযোগ ছিল অন্যদেরও।

আসলে রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রবৃদ্ধির মোহ সবচেয়ে বেশি কাজ করে। এ থেকে তাঁরা বের হতে পারেন না বলেই পরিসংখ্যান নিয়ে এক আলোচনা, বিভ্রাট ও বিভ্রান্তি। আর সব দেশেই এমন সব আমলা আছেন, যাঁরা সরকার কী চায়, সেটাই চর্চা করেন আজীবন। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পরিসংখ্যান কারসাজি মূলত তাঁরাই করে দেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব ছিলেন রীতি ইব্রাহীম। ২৪ বছর পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করার পর ২০১২ সালে তিনি অবসরে যান। ২০১৯ সালে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাকরিজীবনে দেখেছি, কীভাবে ঘষেমেজে উন্নয়নের পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়।’

তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যানের মান নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি সূচক তৈরি করে। এর নাম হচ্ছে ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোর’। সেই সূচকই প্রমাণ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানের মান কত দুর্বল। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের অর্জিত পয়েন্ট হচ্ছে ১০০-এর মধ্যে ৬০। ২০১৪ সালে স্কোর ছিল ৮০। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর তালিকায় স্থান বাংলাদেশের।

৩.

পরিসংখ্যান নিয়ে সবশেষ ঘটনা ঘটিয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি। তাদের দেওয়া তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনে ভারসাম্যের হিসাব তৈরি করেছে, পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস তৈরি করেছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) হিসাব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ইপিবি গত ৯ বছরই রপ্তানির হিসাব বেশি দেখিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ৬ বছর কম কম বাড়িয়ে দেখালেও শেষ তিন অর্থবছরে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দেওয়া হয়। এই তিন অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেশি দেখানো হয়েছে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মাথাব্যথার বড় কারণ ছিল আর্থিক হিসাবের ঘাটতি, যা গত ১০ বছরে হয়নি। এই ঘাটতি ঠিক করতে গিয়েই ধরা পড়েছে ইপিবির কারসাজি, যাকে এখন সবাই বলছে ভুল। গবেষকেরা অন্তত এটিকে ভুল বলতে নারাজ। বরং তাঁরা মনে করেন, এ ঘটনা তথ্য-উপাত্তের ধারাবাহিক কারসাজিরই প্রতিফলন। যদিও কেবল ‘ভুল’ হয়েছে বলে সবাই এখন ঘটনাটি ভুলে গিয়ে সামনে এগোতে চাইছেন। অথচ এটি হচ্ছে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান জগতের কেলেঙ্কারির অন্যতম ঘটনা। এটাকে ‘রপ্তানি আয় স্ক্যান্ডাল’ও বলা যায়।

টাকাকে কৃত্রিমভাবে অতিমূল্যায়িত রাখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাজারে টাকার প্রকৃত যে মূল্যমান, দেখানো হয় তার চেয়ে বেশি। টাকাকে শক্তিশালী দেখানোর খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অথচ ২০১৯ সালেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারকে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, বাংলাদেশ খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি হবে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের হিসাব মেলে না। বাজারে গেলে সাধারণ মানুষেরা টের পান প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আসলে কত। পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে মানুষের মাথাপিছু আয় রাতারাতি বেড়ে যায়, একই সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে তার চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেই তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক আগে থেকেই।

পরিসংখ্যান ঠিক না থাকলে সঠিক নীতি নেওয়াও সম্ভব হয় না। যেমন ইপিবির তথাকথিত ‘ভুল’ তথ্যের কারণে লেনদেনের ভারসাম্যে আর্থিক হিসাবে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করতে সময় নিয়েছে। কারণ, এত বড় ঘাটতি নিয়ে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ডলারের দাম সীমা ছাড়িয়ে যাবে—এমন কথা বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংকারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিজেই বলেছেন। এমনকি তিনি ব্যাংকারদের প্রবাসী আয়ের ওপর অতি গুরুত্ব না দিয়ে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় আনার ওপর জোর দিতে বলেছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নানা সময়ে নেওয়া ভুল নীতির ফলাফল এখনো ভোগ করছে দেশের মানুষ।

৪.

মানুষের কল্পনাশক্তির স্তুতি গেয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি।’ কথাটা যে রবীন্দ্রনাথ অন্তত রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারকদের জন্য লেখেননি, তা সবাই জানি। অথচ এই কথাটা তাঁরাই মানলেন বেশি। তাঁরা যা ঘটে তা বলেন না, যা বলেন সেটাকেই সত্য বলে ধরে নিতে বাধ্য করেন। ফলে পরিসংখ্যানকে নিজের মতো করে তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশেই যে কেবল পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি হয় তা নয়; ভারতে তো এখন প্রতিবছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক উঠছে। চীনের বিরুদ্ধেও এ নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ আছে। নেপালের সাবেক অর্থমন্ত্রী যুবরাজ কাতিওয়াডা যখন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ছিলেন, তখন আড়ালে তাঁকে বলা হতো ‘ডেটা ডক্টর’। বাংলাদেশেও এই ডেটা ডক্টরদের দৌরাত্ম্য ক্রমে বাড়ছে। এটা বন্ধ করতে হবে। পরিসংখ্যানের ওপর ভরসা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসেন না। সবকিছু ঠিকঠাক আছে—এই আত্মপ্রসাদ অর্থনীতির জন্য চরম ক্ষতিকর। সুতরাং ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে’ সহজে নিতে হবে। কারণ, সত্য জানলেই কেবল সমাধান করা সম্ভব।

  • শওকত হোসেন, হেড অব অনলাইন, প্রথম অালো