মতামত

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও মিয়ানমার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২১ জুন ২০২৩ তারিখে রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছান। ২২ জুন তিনি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন এবং তাঁর সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। পরদিন সফর নিয়ে ৫৮ অনুচ্ছেদের এক যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়।

যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয়ই উঠে আসে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা আলোচনায় অধিক গুরুত্ব পায়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের ওপর উভয় পক্ষ গুরুত্ব দেয়। বৈঠকের আগে ভারতের তেজাস জঙ্গি বিমান ইঞ্জিন যৌথভাবে নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল অ্যাটমিকস থেকে ৩১টি এমকিউ ৯-বি সশস্ত্র ড্রোন কিনবে তিন বিলিয়ন ডলারে। ড্রোনগুলো সংযোজিত হবে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ভারতে তাদের জাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে মার্কিন সমর্থনের কথাও পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এয়ার ইন্ডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ১০০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করায় উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন।

মোদির সফর-পূর্ববর্তী সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে নমনীয় হতে অনুরোধ করবেন কি না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই অস্বীকার করা হয়েছে, অনেকেরই ধারণা ছিল, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে এ রকম একটি অনুরোধ করা হয়েছে। ২০ জুন নয়াদিল্লিভিত্তিক হিন্দুস্তান টাইমস-এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপোড়েন, এ বিষয়ে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো কথা হয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। সফরের আগে ঢাকার একটি থিঙ্কট্যাংকের ‘ওয়াশিংটন কানেকশন’ জানিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর ভারতের কোনো ‘লিভারেজ’ নেই। বিষয়টি তাই আলোচনায় আসবে না। হোয়াইট হাউস ব্রিফিংয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিষয়টিকে খানিকটা এড়িয়ে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তাদের নিজেদের বিষয়। আর বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশাও স্পষ্ট। তবে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় না এলেও বিষয়টি যে সম্পূর্ণ অনুল্লিখিত থেকেছেই, এমনটি নিশ্চিত হওয়া যায় না। দুই নেতার একান্ত সাক্ষাতে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা তো আমরা জানি না।

সন্ত্রাসবাদ আর সেই সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সামান্য উল্লেখ আছে শুধু ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক, পূর্ব এশিয়াসহ আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে দুই সরকারের মধ্যে চলমান গভীর, গতিশীল পরামর্শ অনুষ্ঠানকে উভয় নেতা স্বাগত জানান এবং ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় ইন্ডিয়ান ওশেন ডায়ালগের উদ্বোধনী অধিবেশন নিয়ে তাঁদের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে অনেক বেশি শব্দাবলি বিধৃত হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। প্রত্যাশিতভাবেই তাতে প্রচ্ছন্ন চীনবিরোধিতার নিদর্শন আছে বেশ। চীনের সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বৈরী সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে যৌথ ঘোষণায় একই রকম ছোট একটি অনুচ্ছেদ আছে। সেটি এ রকম— মিয়ানমারের অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে উভয় নেতা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নির্বিচার গ্রেপ্তার করা সবার মুক্তি, গঠনমূলক সংলাপ শুরু এবং মিয়ানমারে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ফেডারেল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের আহ্বান জানান।

যেকোনো বিচারেই, এই অনুচ্ছেদের বক্তব্য খুবই জেনেরিক ও নমনীয়। এতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের কোনো উল্লেখ নেই, যে অপরাধ তারা করেছে এবং করছে, তা-ও অনুপস্থিত। তবে মিয়ানমার প্রসঙ্গে যে বিষয়টি একেবারেই বাদ পড়ে গেছে, তা হচ্ছে সে দেশ থেকে বিতাড়িত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। মিয়ানমার নিয়ে অনুচ্ছেদে চলমান সংঘাতের সঙ্গে অন্তত রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টির ন্যূনতম উল্লেখ থাকতে পারত।

কয়েক দিন আগে ভারতের বেনারসে জি-২০ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রীদের সভায় আমন্ত্রিত হয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অংশ নেন এবং সেখানে আলাদাভাবে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকায় জোর আলোচনা ছিল যে তিনি নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফরে নির্বাচন নিয়ে যেন যুক্তরাষ্ট্র কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, এ নিয়ে ভারতকে ভূমিকা নেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি আসলেই তা করেছেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা কঠিন। তবে এখানে একটি সুযোগ ছিল ভারতকে অনুরোধ করার, যেন মিয়ানমার প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পক্ষে দু-চারটি শব্দ সংযোজিত হয়, যেহেতু বাংলাদেশ এ নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালের অন্যতম কঠিন সংকট মোকাবিলা করছে।

মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে সুসম্পর্ক সত্ত্বেও ভারত বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পক্ষেই বলেছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোও সাধারণভাবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সহানুভূতিশীল। ভারতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখালে যুক্তরাষ্ট্র তাতে সুর মেলাত, এমনটি প্রত্যাশাই করা যায়। অনেক সংকটের ভিড়ে পুরোনো সংকটকে ভুলে যাওয়া বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রচলিত অভ্যাস। রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে বিষয়টি এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সংকটের ভুক্তভোগীদের তাই চেষ্টা করতে হয় প্রতি সুযোগেই বিষয়টি টেনে আনার, যাতে যৌথ স্মৃতিতে তা জাগরূক থাকে। এটি ছিল তেমন একটি সুযোগ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর টিম আরেকটু অ্যালার্ট থাকবেন কি?

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব