পরিবেশবাদীদের নানা আন্দোলনের পরও মেহগনিগাছটি কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে।
পরিবেশবাদীদের নানা আন্দোলনের পরও মেহগনিগাছটি কেটে মাটিতে ফেলা হয়েছে।

মতামত

রাজশাহীর উন্নয়নে কি গাছ-পাখিদের ঠাঁই নেই

সম্প্রতি রাজশাহীর প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সচেতন নাগরিক সমাজ রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সেখানকার গাছগুলো না কেটে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে অনুরোধ কানে না তুলে গাছ কাটা শুরু করলে গাছকে শহীদ করে শহীদ মিনার নির্মাণে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ নগরবাসী প্রতিবাদে শোকসভা পর্যন্ত করেন।

তাঁরা দাবি করেন শতবর্ষী গাছ রেখে পরিবেশবান্ধব কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের। তাঁরা বলেন, বৃক্ষশোভিত সবুজ ঘাসে মুড়িয়ে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হলে এটি হতে পারে সবুজের শহর, শান্তির শহরের একটি প্রতীকী স্থাপনা। কিন্তু শেষ অবধি গাছগুলোকে বাঁচাতে পারেনি, সবার অগোচরে ভোরে কেটে ফেলা হয় শতবর্ষী প্রকাণ্ড মেহগনিসহ সব গাছ। গাছের ডালে ডালে ছিল পাখির বাসা। এগুলোর কোনোটিতে ডিমও ছিল।

একটি গাছ কাটা মানে শুধু বৃক্ষ হত্যা নয়, অনেক জীবন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা, অনেক পাখি-পতঙ্গ-পিপীলিকার আবাসস্থল ধ্বংস করা। পরিবেশবান্ধব বা গ্রিন সিটি বলে দাবি করা শহরে এমন উদ্যোগ অনেককে আশাহত করেছে।

রাজশাহী নগরে চোখধাঁধানো ও ঈর্ষণীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেছে। নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ, উড়ালসেতু নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণ ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজশাহীর রাজকীয় চেহারা ফুটে উঠেছে। সন্ধ্যা নামতেই সড়কগুলোয় নামে আলোর মিছিল। জ্বলজ্বল করে ওঠে গোটা শহর। শোভা পায় নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও ব্যয়বহুল বাতি। আলোর ছটায় ভরে থাকে রাতের আকাশ। ইতিমধ্যে পরিচ্ছন্ন শহর ও বিশুদ্ধ বাতাসের তালিকায়ও রাজশাহী স্থান করে নিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এ উন্নয়ন ও সৌন্দর্য কতটুকু পরিবেশবান্ধব। পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য। উন্নয়নের নামে দিন দিন বৃক্ষনিধন হচ্ছে, সবুজায়ন কমে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে প্রাণহীন এক নগর। তাঁরা আকাশমুখী গুচ্ছবাতির অত্যধিক আলোরও সমালোচনা করে বলছেন, এই তীব্র আলোকায়ন পাখি ও পতঙ্গের জন্য আলোকদূষণ করে এবং রাস্তার পাশের গাছগুলোয় বাস করা পাখিসহ অন্যান্য পোকামাকড়ের রাতের ঘুমের বা বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটায়।

পুকুরের নগরী হিসেবে একসময় পরিচিতি ছিল রাজশাহী। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, গত কয়েক দশকে রাজশাহী নগরীর প্রায় ৯৭ শতাংশ পুকুর-জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। পুকুরকে সংরক্ষণযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পুকুর ভরাট রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে পুকুর ও জলাশয় রাতের আঁধারে গুম হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সোনাদিঘিকে এখন চারদিক থেকে কংক্রিটের উন্নয়ন গ্রাস করেছে। অনেকটাই চোখের আড়ালে চলে গেছে।

পদ্মা আবাসিক এলাকার ভদ্রা পার্কের অবস্থা দেখলে পরিবেশবাদীদের কষ্ট বাড়ে। পার্কের সেই বড় দিঘি, নারকেলগাছের সারি আর সবুজে ঘেরা পার্কের শরীরজুড়ে এখন কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। রাজশাহীতে পদ্মার পাড় কিংবা ভুবনমোহন পার্কে পুরোটা সিমেন্ট বা টাইলস দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে, যা প্রাকৃতিক পরিবেশবান্ধব নয়।

রাজশাহী শহরের একসময়ের গর্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক রাজশাহীর চিড়িয়াখানা। একসময়ে উত্তরাঞ্চলের প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণ ছিল এ চিড়িয়াখানা। এটি এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাভ্রমণের জন্য একটি অন্যতম স্থান। উন্নয়নের ছোঁয়ায় চিড়িয়াখানার পশুপাখি হারিয়ে যেতে বসেছে। অবশিষ্ট আছে দুটি ঘড়িয়াল আর কিছু হরিণ। এক প্রান্তজুড়ে তৈরি হয়েছে নভোথিয়েটার। সেই বৃক্ষশোভিত সবুজে ঢাকা ছায়াঘেরা পরিবেশ আর নেই।

দিনে দিনে কংক্রিটের তৈরি জঙ্গলে রূপান্তরিত হতে চলেছে। প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের যোগাযোগ এবং বিভিন্ন পশুপাখি সম্পর্কে জানা ও তাদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নগরের উন্নয়নে জলাশয়গুলো যেমন গুম হচ্ছে, তেমনি খুন হচ্ছে বহু গাছ। এই অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি শহুরে বনায়ন এবং সবুজ আবরণ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী। প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস শুধু জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিতই করে না; বরং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকেও ব্যাহত করে, যা শেষ পর্যন্ত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

অথচ গাছ রক্ষা করে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত এ শহরেই আছে। নগরীর ভদ্রা মোড় থেকে রেলস্টেশন যাওয়ার রাস্তাটির গাছগুলো না কেটেই ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কটি এখন রাজশাহী নগরীর সবচেয়ে ছায়াময় ও শীতল সড়ক। বিশ্বের অনেক দেশে গাছকে বাঁচিয়ে সড়ক ও ভবন নির্মাণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।

সাম্প্রতিক কালে আমরা যে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, তা মোকাবিলায় নিছক লোকদেখানো পদক্ষেপ ও উদাসীন প্রচেষ্টাই যথেষ্ট হবে না; প্রকৃত টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন যথার্থ পরিকল্পনা, দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা, যা পরিবেশ সুরক্ষার বিভিন্ন দিক ও পরিবেশগত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করে।

নাগরিক উন্নয়নের জন্য ইট–পাথর–সুরকির প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আকর্ষণ কমিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি বেশি নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কেননা, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দিন শেষে আমরা প্রত্যেকেই উন্নয়ন চাই। তবে সেটি হোক প্রকৃতিকে ভালোবেসে, গাছকে বাঁচিয়ে এবং পাখির ঘর রক্ষা করে। অন্যথায় কেটে ফেলা গাছগুলোর শরীরের বাকল তুলে যেভাবে কালি দিয়ে বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হচ্ছে, আমাদের আগামী প্রজন্ম তেমনি আমাদের বুকে নামফলক ঝুলিয়ে লিখে রাখবে, ‘তুমি অপরাধী, তুমি গাছ নিধনকারী’।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ই–মেইল: faridecoru@yahoo.co.uk