প্রথম আলোর একটি অনলাইন প্রতিবেদন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য তৈরি করা একটি ফটোকার্ডকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা ও একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন সাংবাদিকতা, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতামত কলামটি লিখেছেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। দ্য ডেইলি স্টার–এর সৌজন্যে কলামটি প্রথম আলোতে প্রকাশ করা হলো।
এই লেখা অন্যের মতকে খণ্ডনের জন্য নয়, আলোচনার জন্য; প্রত্যাখ্যান নয়, বিতর্কের জন্য; বিরোধিতা নয়, অনুসন্ধানের জন্য; তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সিদ্ধান্তে উপনীত হতে নয়, প্রমাণ সাপেক্ষে ঘটনার যথার্থতা বিচারের জন্য; কারও মতের কারণে কোনো তকমা লাগাতে নয়, বিষয়টি যেভাবে আমাদের সামনে এসেছে, সেভাবেই মূল্যায়ন করে দেখার জন্য।
অন্যের দিকে আঙুল না তুলে নিজেদের কাছে যে প্রশ্ন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, নিজেদের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেও প্রাণপ্রিয় যে পেশায় আমরা আছি, সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
সর্বোপরি এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিনীত ও আন্তরিকভাবে আমার সাংবাদিক সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করা, যেন তাঁরা তাঁদের কাজে, হৃদয়ে ও মননে আত্মবিশ্লেষণ করেন, প্রশ্ন করেন ও অনুসন্ধান করেন যে কোথায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সমাপ্তি হচ্ছে এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকতার শুরু হচ্ছে।
এই লেখার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমার সাংবাদিক সহকর্মীদের এটা নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে অনুরোধ করা যে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে যেসব ভুল হয়ে যায় বা ভুল থেকে যেসব সমস্যা তৈরি হয়, সেটা কীভাবে মেটাবেন?
একটি সংবাদপত্রে ২৪ ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
অনেকের ক্ষেত্রে কিছু কম হতে পারে। আমরা যদি ছবি, কার্টুন, ইনফোগ্রাফ, ছবির ক্যাপশনগুলোও সঙ্গে যোগ করি, তাহলে সংখ্যাটি ৩৫০–এর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। যদিও রহস্যজনকভাবে রাজনৈতিক কার্টুনগুলো আজকাল আর দেখা যায় না এবং কেন দেখা যায় না, সেই প্রশ্নেরও উদ্রেক করে। যা–ই হোক, প্রতিবেদনের এ তালিকায় মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট যোগ করলে সংখ্যাটি আরও বড় হবে।
গণমাধ্যম কোনো ভুল করলে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বজনীন, পরীক্ষিত ও প্রমাণিত কিছু নীতি আছে। বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে এগুলো তৈরি হয়েছে। আমরা কি সেগুলো মেনে চলছি? না মেনে থাকলে, আমাদের কি মেনে চলা উচিত নয়? সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কি উচিত নয় এটা নিশ্চিত করার দাবি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা? আমরা কি তা করছি? নাকি এমন কোনো ভুলের জন্য সাংবাদিক সহকর্মীদের মুণ্ডপাত করতে ব্যস্ত রয়েছি, যার ব্যাখ্যা খুব সহজভাবেই সাংবাদিকতার ভাষায় করা যায়?
প্রতিদিন এই পরিমাণ প্রতিবেদন তৈরি করতে তথ্য সংগ্রহ, লেখা, সম্পাদনা করা, পেজ সেটিং, ছবি তোলা ও সংযোজন, ক্যাপশন লেখা, অডিও রেকর্ডিং, ভিডিও ধারণসহ পর্বতসম কাজ করতে হয়। আমাদের সাংবাদিক সহকর্মীদের এ ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দিতে হবে যে তাঁদের ভুলের সংখ্যা খুবই কম। ‘মানুষমাত্রই ভুল করে’ প্রবাদটি সত্য হলে নির্ভুল থাকার যত চেষ্টাই করি না কেন, আমাদেরও ভুল হতেই পারে। তাই এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নজর দিতে হবে।
গণমাধ্যম কোনো ভুল করলে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বজনীন, পরীক্ষিত ও প্রমাণিত কিছু নীতি আছে। বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে এগুলো তৈরি হয়েছে। আমরা কি সেগুলো মেনে চলছি? না মেনে থাকলে আমাদের কি মেনে চলা উচিত নয়? সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কি উচিত নয় এটা নিশ্চিত করার দাবি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা? আমরা কি তা করছি, নাকি এমন কোনো ভুলের জন্য সাংবাদিক সহকর্মীদের মুণ্ডুপাত করতে ব্যস্ত রয়েছি, যার ব্যাখ্যা খুব সহজভাবেই সাংবাদিকতার ভাষায় করা যায়?
সাংবাদিকদের মনে প্রশ্ন ওঠা উচিত, জনমানুষের কাছে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য বাংলা দৈনিকটিকে হেয় করার জন্য আমাদেরই অনেকে কেন এত উঠেপড়ে লাগলেন? প্রথম আলোর ‘ভুলের’ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করার সময় কি সাংবাদিকতার নীতি বজায় রাখা হয়েছে? প্রথম আলোর তথাকথিত ‘উদ্দেশ্য’ কি তাদের অনুসন্ধানে প্রমাণসহ উঠে এসেছে? হঠাৎ কেন ‘মতামত’কে ‘তথ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হলো? একটি সংবাদপত্রের দীর্ঘ ইতিহাস বিবেচনায় না নিয়ে কেবল দু–একটা ভুল দিয়ে কেন বিচার করা হলো এবং পরবর্তীকালে কেন সমালোচকেরা কোনো তথ্যের সূত্র না দিয়েই নিজেদের মতো করে সেটি বিশ্লেষণ করলেন?
আমরা যদি বলি, প্রথম আলোকে নিয়ে সমালোচনার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি, তাহলে সেটা কি পুরোপুরি অযৌক্তিক হবে? আমরা যদি বলি, প্রথম আলোর নয়, বরং অন্যদের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো, গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা; কণ্ঠ রোধ করা না গেলেও অন্তত ভয় দেখানো।
সাম্প্রতিক ঘটনাটি এমন—দেশের সবচেয়ে বড় বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা করা হয়েছে।
পত্রিকাটির সাভারে কর্মরত নিজস্ব প্রতিবেদককে ‘অপহরণই’ করা হয়েছিল বলা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সাদাপোশাকে তাঁর বাড়িতে হানা দেন, কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই তুলে নেন এবং তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁকে বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাউকে কোনো তথ্য দেননি। পরবর্তী ২০ ঘণ্টা তিনি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন। এরপর তাঁকে আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নটি করা উচিত ছিল, কী অপরাধ ছিল তাঁর? মিথ্যা তথ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ? তাঁর প্রতিবেদনের কোন অংশটি মিথ্যা ছিল? পুরো বিতর্কটি তৈরি করা হয়েছে একটি শিশুর ছবি এবং একজন দিনমজুরের মন্তব্য একসঙ্গে ব্যবহার করা নিয়ে, যা ওই ছবিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা ছিল। সাংবাদিক হিসেবে আমরা কি এটা জানি না যে একটি প্রতিবেদন কোন শিরোনামে যাবে, সেখানে কোন ছবি ব্যবহার করা হবে, প্রতিবেদনটি কোন পাতায় প্রকাশিত হবে কিংবা কোন সময় প্রচার বা প্রকাশ করা হবে—এর কোনোটিই প্রতিবেদকের হাতে নেই কিংবা এগুলো তাঁর দায়িত্ব নয়।
অথচ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ছাড়া আর কারও বিবৃতিতেই যেসব প্রশ্ন করা হয়নি, তা হলো, কেন ওই সাংবাদিককে তাঁর সব ধরনের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই ‘তুলে নেওয়া’ হলো? উচ্চ পর্যায় থেকে কাউকে ‘তুলে নেওয়া’র নির্দেশ এলেই সাংবিধানিক অধিকারগুলো ভিত্তিহীন হয়ে যায়? সাংবাদিকদের কি উচিত ছিল না এসব প্রশ্ন করা?
বিবৃতিগুলোয় ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার অভিযোগ তুলে প্রথম আলোর নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের কি উচিত ছিল না—কোনো সাংবাদিককে তো নয়ই, দেশের কোনো নাগরিককেই ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার মতো অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও পক্ষপাতদুষ্ট কারণ দেখিয়ে গ্রেপ্তার বা মামলা করা যাবে না—এ দাবিতে সবাই একাত্ম হয়ে আওয়াজ তোলা? আইন কখনো অস্পষ্ট হতে পারে না। আইন হবে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সেখানে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ থাকতে পারে না। অন্যথায় সেটি আর আইন থাকে না। সেটি পরিণত হয় হয়রানি ও শোষণের হাতিয়ারে। ঠিক যেমনটি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে।
একজন রাজনীতিবিদের দৃষ্টিতে যেটি ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে’, সেটি একজন সাংবাদিকের কাছে ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ হতে পারে। কেউ চাইলেই দাবি করতে পারেন যে বঙ্গবাজারের আগুন, সড়ক দুর্ঘটনা, ওষুধে ভেজাল, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদীদখল, পানিতে আর্সেনিক, লাগামহীন দুর্নীতি, বেশির ভাগ বাস-ট্রাকচালকের ভুয়া লাইসেন্স, যানবাহনের ফিটনেস সনদ না থাকা—এসব বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করলে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাহলে কি এসব বিষয়ে প্রতিবেদন করা মানেই দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করা, স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা? সাংবাদিক হিসেবে যদি এসব বিষয়ের জনগুরুত্ব বুঝতেই না পারি, তাহলে কেন এসেছি সাংবাদিকতা পেশায়?
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের যুক্তি হলো, এটা কোনো ভুল নয়, বরং ‘স্বাধীনতাকে’ হেয় করা এবং ‘মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার’ দীর্ঘমেয়াদি ‘অ্যাজেন্ডার’ বাস্তবায়ন। একজন দিনমজুরের কথাকে একটি শিশুর ছবির সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই এত কিছু করে ফেলা যায়? কোন তথ্যের ভিত্তিতে বা পত্রিকার কোন কনটেন্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এসব দাবি করা হচ্ছে?
এগুলো আসছে কোথা থেকে? স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে প্রথম আলোর সমালোচকেরা কি এই দাবি করছেন যে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীনতা এতটাই ভঙ্গুর, দুর্বল ও দ্বিধান্বিত যে একটি প্রতিবেদন করেই এর ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়া যায়? তাঁদের এই দাবি কি আমাদের সব অর্জনের প্রতি পরিহাস করা নয়? এসব ঘটনা এমন সময়ে ঘটছে, যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি। তাহলে সত্যিকার অর্থে কারা বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে?
প্রথম আলোর দীর্ঘ ইতিহাস থেকে কী জানতে পারি? আমাদের ভাষা আন্দোলন, ’৫০, ’৬০ ও ’৭০-এর দশকের আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকারসহ যা কিছু বাংলাদেশের পক্ষে, তার প্রতি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে আসছে পত্রিকাটি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পত্রিকাটির ভূমিকা অতুলনীয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সব সাফল্যকে এখনকার সমালোচকদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গেই প্রচার করেছে প্রথম আলো।
সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও অন্য যাঁরা সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলো দিয়েছেন, তাঁরা হয়তো বিএনপির শাসনামলে দুর্নীতির বিষয়গুলো তুলে ধরা এবং সেই সময়ে তারেক জিয়া ও হাওয়া ভবনের কীর্তিকলাপ উন্মোচনে প্রথম আলোর ভূমিকার কথা ভুলে গেছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ঘৃণ্য উদ্যোগ উন্মোচন করতে কী ভূমিকা রেখেছিল প্রথম আলো।
‘জজ মিয়া’ ষড়যন্ত্র কারা উন্মোচন করেছে? আইভি রহমানসহ ২৪ আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকে গোপন করতে বিএনপি যে ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল, সেটিও উন্মোচন করে প্রথম আলো। ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটারের তথ্য কারা প্রকাশ করেছিল? ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন হাওয়া ভবন ও বঙ্গভবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছিল কারা? নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান বিপদ হিসেবে বিবেচিত বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা কী ছিল?
একটি মুক্ত গণমাধ্যম হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা, প্রথম আলো তা–ই করেছে। পত্রিকাটি ক্ষমতাসীনদের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এই ১৪ বছরের মেয়াদে পত্রিকাটি একইভাবে তাদের পেশাদারি দায়িত্ব পালন করে আসছে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা সেটা ভুলে যেতেই পারেন, কিন্তু সাংবাদিকদের কি ভুলে যাওয়া উচিত?
প্রথম আলো যে কাজ করেছে, সেটি আদতে কোনো ভুল ছিল কি না, তা নিয়ে সাংবাদিকতার কোনো ক্লাসে আলোচনা বা বিতর্ক হতে পারে। আপাতত তর্কের খাতিরে মেনে নিচ্ছি যে প্রথম আলো ভুল করেছে। তবে তাদের এই ভুলকে পরিণত করা হয়েছে একটি রাজনৈতিক চালে, যাতে চাপে ফেলে স্বাধীন পত্রিকা হিসেবে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করানো এবং একটি পেশাদার গণমাধ্যমকে হেয় করা যায়।
তা না হলে হঠাৎই ১৯৭৪ সালে ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘বাসন্তী’র ছবির বিষয়টি এখন কেন মাথাচাড়া দিল? কোন ভিত্তিতে প্রথম আলোর এই সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের সঙ্গে পুরোনো আমলের ওই ঘটনার তুলনা করা হলো? এটা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে, যাতে আমাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং বিভ্রান্তি ও বিভেদ তৈরি করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের বিষয়গুলো নিয়ে প্রথম আলোর তথাকথিত বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে যত ধরনের কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটিই ভিত্তিহীন। এই পত্রিকা যতগুলো সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার সব কটাই ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিতের নৈতিক ও পেশাগত ভূমিকার মধ্যেই পড়ে। কোনো কারণ না থাকলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রথম আলো এতটা গ্রহণযোগ্যতা ও প্রশংসা অর্জন করতে পারত না।
শিরোনামেই বলেছি, শুধু আমরা সাংবাদিকেরাই আমাদের পেশাকে বাঁচাতে পারি। বাকি সবাই সাংবাদিকতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। সরকার যখন আমাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তারা চায়, সাংবাদিকেরা কায়মনোবাক্যে সরকারের প্রতিটি নির্দেশনা মেনে চলবেন; যখন ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাহায্যের প্রস্তাব আসে, তখন সেই সাহায্যের মূল্য দিতে হয় তাদের আইন ভঙ্গ করার ঘটনাগুলো দেখেও না দেখে; যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে, তখন তারা চায়, আমরা যেন তাদের আইন ভঙ্গের ঘটনাগুলো হালকা করে লিখি; যখন রাজনীতিবিদেরা আমাদের প্রশংসা করেন, তখন বুঝতে হবে, তাঁরা এখন ক্ষমতার মধু থেকে বঞ্চিত এবং নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতার স্বাদ পেলে তাঁরা বিপরীত রূপ দেখাবেন।
কেউ চায় না আমরা স্বাধীন থাকি, বস্তুনিষ্ঠ থাকি এবং সত্য বলি। এখানেই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ এবং এ কারণেই চিন্তা ও চেতনার পার্থক্য থাকলেও আমাদের সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে।
এর অর্থ এই নয় যে আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য থাকবে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আমাদের মতপার্থক্য, এটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিক হিসেবে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রাজনৈতিক চিন্তা লালন করতেই পারি, কিন্তু সেটা যেন সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত না করে।
আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনের অন্তিম সময় পার করছি। হয়তো আর কয়েক বছর বাকি। জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় সময় আমি কাটিয়েছি আরও লাখো মানুষের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে। এরপর ১৯৭২ সালের এপ্রিলে কাজ শুরু করি বাংলাদেশ অবজারভারে। দ্য ডেইলি স্টারের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ শুরু করে গত ৩২ বছর আমি এ পত্রিকার সঙ্গে আছি। কাজেই, এটা দাবি করতে পারি যে সাংবাদিক হিসেবে আমার যৎসামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী সাংবাদিক সহকর্মীরাই ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবেন। মূলত তাঁদের উদ্দেশ্যেই আমার এ লেখা। আমি নির্দ্বিধায় এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, সবচেয়ে মহান পেশাগুলোর মধ্যে সাংবাদিকতা অন্যতম। একটি সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক, গণতান্ত্রিক, ন্যায়পরায়ণ ও ন্যায়সংগত উন্নয়নের জন্য শিক্ষা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাংবাদিকতা। প্রশাসনের জবাবদিহির জন্যও সাংবাদিকতা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একটি সমাজে মুক্ত সাংবাদিকতা প্রয়োজন।
যেসব কথা লিখেছি, তা যদি আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হয়, তাহলে আমাকে তিরস্কার করতে পারেন। কিন্তু আত্মজিজ্ঞাসা করতে ভুলবেন না—আমরা সাংবাদিকেরা কি মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারছি, নাকি সেগুলো পক্ষপাতমূলক এবং রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থে আচ্ছন্ন?
এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ। মনে রাখবেন, সাংবাদিকতাকে শুধু সাংবাদিকেরাই বাঁচাতে পারেন।
মাহফুজ আনাম সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান