নিউ স্টার্ট চুক্তি (পরমাণু চুক্তি) থেকে মস্কো বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেওয়ার পর রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছে।
চীনের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ওয়াং ই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দুই দেশের বাড়ন্ত সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। একই সঙ্গে বেইজিং ও মস্কো যে বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থা দেখতে চায়, সেই অঙ্গীকারও তিনি ব্যক্ত করেছেন। চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং এ ধারাবাহিকতায় বলেছেন, ‘বিশ্বে আজ যেভাবে অস্থিতিশীলতা বাড়ছে, তাতে রাশিয়া-চীনের সম্পর্ক টেকসই হওয়া প্রয়োজন।’
আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমেরিকান গোয়েন্দারা দাবি করেছেন, বেইজিং মস্কোকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। সেই অস্ত্র ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করবে রাশিয়া।
চীন ও রাশিয়ার উপর্যুপরি এই কূটনৈতিক উদ্যোগকে কীভাবে দেখছে ওয়াশিংটন? ভারতের প্রতি ওয়াশিংটনের সরাসরি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
রাশিয়ানদের সঙ্গে চীনাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক কোন দিকে গড়াচ্ছে, সেটা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রাধিকারের বিষয়। ভারতকে ক্রেমলিনের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটা জরুরি তাগিদ গত কয়েক সপ্তাহে ওয়াশিংটনের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে। মস্কো ও বেইজিংয়ের সম্পর্কের ধরনের কারণেই সেটা করছে ওয়াশিংটন।
রাশিয়ার রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা এ ব্যাপারে সতর্ক যে চীনের সঙ্গে তাদের একপক্ষীয় সম্প্রীতির বিষয়টি নিম্নস্তরের সম্পর্কের একটি চিহ্ন হয়ে থাকবে। তাতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল ঐতিহাসিক নীতির লঙ্ঘন। সেটি হলো, ইউরেশিয়া অঞ্চলে অবস্থানের কারণে ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার যে অনন্য বৈশিষ্ট্য, সেটা ব্যবহার করে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে থেকে যেতে চায় রাশিয়া। এ কারণে একই সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায়।
যা-ই হোক, ২০১৪ সালে ব্রিকসের বাৎসরিক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যদি কোনো ভারতীয়কে আপনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে সেরা বন্ধু কোন দেশ, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি, এমনকি প্রত্যেক শিশু জানে যে সেই দেশ রাশিয়া।’ ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে ব্যবসা, পেশাজীবী ও কারিগরি সেবা রপ্তানি ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৪০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
এসব কারণেই রাশিয়া ভারতের সঙ্গে জোট করতে চাইবে, যাতে তাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকে। মস্কো এটা নিশ্চিত করতে চাইবে যে তারা যেন কেবল চীনের মুনাফার কারখানা হয়ে না ওঠে।
চীনের সঙ্গে ঐক্যের বাস্তব প্রতিফলন দেখে ইতিমধ্যে অনেক রাশিয়ান সতর্কবার্তা বাজিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ লিওনিড পাইদিয়েভ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির বিনিময়ে বেইজিংয়ের ওপর মস্কোর নির্ভরতা রাশিয়াকে চীনের করদ রাষ্ট্র অথবা উপনিবেশে পরিণত করতে পারে।
ভিয়েনা ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক স্টাডিজের অর্থনীতিবিদ ভাসিলি আসট্রভ চীনের সঙ্গে রাশিয়ার এই সহযোগিতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘মস্কো এটি বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করেছে। এটা সচেতন এবং বিবেচনাপ্রসূত কোনো সিদ্ধান্ত নয়...কেননা, তাদের সামনে এর একমাত্র বিকল্প ছিল একঘরে হওয়া।’
একদিকে রাশিয়া খুব ভালো করেই জানে যে তারা চীন ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। না হলে বিশ্ব থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে চীনের করদ রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার ভীতি রয়েছে। এই দ্বিধা এড়াতে মস্কো এখন ভারতের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে।
পুতিনকে বলা ওয়াং ই-এর সাম্প্রতিক মন্তব্যের মতো করেই রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ জানুয়ারি মাসে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ভারত এমন একটি দেশ, যাদের ‘বহু মেরুর বিশ্ব তৈরির অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়া’য় অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লাভরভ একই তালিকায় চীন, তুরস্ক, মিসর এবং পারস্য উপসাগর ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে রেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমকে একটি নিখাদ ধারণা দিতে চাইছে রাশিয়া। সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিশ্বব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে মস্কো কোনো কোনো দেশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একই মাসে পুতিনের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ বলেন, বিশ্ব এরই মধ্যে বহু মেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়ায় ‘দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক’ সন্ধিস্থলে রয়েছে।
দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা, বিশাল জিডিপি ও প্রযুক্তি খাতে উদীয়মান শক্তি হওয়ায় মস্কোর তালিকায় থাকা ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল অংশীদার ভারত। কিন্তু চীনের সঙ্গে ভারতের যে অব্যাহত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাতে মস্কো ভারতের সঙ্গে কিছুটা দেখেশুনে চলার নীতিতে চলেছে।
যাহোক, চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা গভীর রূপ নেওয়ায় মধ্যেই মস্কো নানা সম্পদের জন্য নয়াদিল্লির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
সূত্রমতে, মস্কো তাদের প্রকৌশল ও চিকিৎসা ইনস্টিটিউটের জন্য ভারতের মেধাবীদের আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা রেকর্ড ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সংখ্যার দিক থেকে চীনা শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকলেও ভারতীয় শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হার ছিল অনেক বেশি।
দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ আবেদনপ্রক্রিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম খরচ হওয়ায় মেধাবীরা রাশিয়ায় পড়তে যেতে প্রলুব্ধ হচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি খাড়গপুর এবং মস্কো এভিয়েশন ইনস্টিটিউট যৌথভাবে মঙ্গল গ্রহে মনুষ্যবিহীন যান পাঠানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে রাশিয়ান-ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের ১২তম অধিবেশনে ভারতীয় গবেষকদের রাশিয়ান পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
বিজ্ঞানে এই সহযোগিতা সম্ভব হচ্ছে দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণেই। ২০১০ সালে রাশিয়া ও ভারত তাদের ‘বিশেষ ও বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারত্ব’ ঘোষণা করে। কিন্তু গত বছরে রাশিয়ার পারমাণবিক হুমকির প্রেক্ষাপটে ভারত যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, তা থেকে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা ফাটলের বিষয়টা উঠে এসেছিল।
যা-ই হোক, ২০১৪ সালে ব্রিকসের বাৎসরিক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যদি কোনো ভারতীয়কে আপনি জিজ্ঞেস করেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে সেরা বন্ধু কোন দেশ, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি, এমনকি প্রত্যেক শিশু জানে যে সেই দেশ রাশিয়া।’ ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে ব্যবসা, পেশাজীবী ও কারিগরি সেবা রপ্তানি ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৪০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
পরিশেষে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল গত মাসে রাশিয়া সফর করেছেন। দুই দেশের বিশেষ অংশীদারত্বের সম্পর্ক পরবর্তী ধাপ কী হবে, তা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
ভারতকে এভাবে রাশিয়ায় সঁপে না দিয়ে ওয়াশিংটনকে অবশ্যই নয়াদিল্লিকে বলতে হবে যে রাশিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকা তাদের জাতীয় স্বার্থ। সেটা কীভাবে সম্ভব? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া জি-২০ সম্মেলন এর একটা সম্ভাব্য দৃষ্টান্ত।
উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নিয়েই কথা বলতে চায় ভারত। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংঘাত শুরুর পর থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ওপর জোর দিয়ে চলেছে। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই নয়াদিল্লিকে বলতে হবে যে ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে বিশ্বব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটন বাণিজ্য বাড়াতে পারে, কোয়াডের মাধ্যমে প্রযুক্তি সহায়তা বৃদ্ধি করতে পারে। চীনের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ নীতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কও বাড়াতে পারে।
আক্সেল দ্য ভারনিউ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও বৈশ্বিক বিষয়াদি বিষয়ে গবেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে