রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যে চিত্তাকর্ষক গল্প হবে না, সেটা সবারই জানা ছিল। যেসব প্রার্থী প্রেসিডেন্টকে সত্যিকারভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতিতে ভ্লাদিমির পুতিনের বিজয় অনেক বেশি সুনিশ্চিত ছিল।
হ্যাঁ, এই নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আরও ছয় বছরের জন্য রাশিয়ার দায়িত্বে থাকবেন পুতিন। হয়তো সবচেয়ে সামরিক ও আগ্রাসী সংস্করণে আবির্ভূত হবেন তিনি।
পুতিনের পুনর্নির্বাচিত হওয়াকে ক্রেমলিন দেখাতে চায়, ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষে গণ রায়। রাশিয়া ও পশ্চিমা—দুই দিকের জনসাধারণের মধ্যে খুব সতর্কতার সঙ্গে এই প্রত্যয় জন্মাতে চায় যে রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইউক্রেনকে পরাজিত করা এবং পশ্চিমাদের খাটো করার জন্য পুতিন সরকারের প্রচেষ্টার পেছনে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে এসেছেন ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংহতি তৈরি করার শর্ত’ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্রেমলিনের একটি উৎস রাশিয়ার স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছিল, জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, সেটা দেখাতে প্রেসিডেন্ট প্রশাসন পুতিনের পক্ষে ৮০ শতাংশ ভোট পড়ার একটি অভূতপূর্ব লক্ষ্য ঠিক করেছে। ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, পুতিনের পক্ষে ভোট পড়েছে ৮৭ শতাংশের বেশি।
এই পরাবাস্তব ফলাফলের পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। এক, ক্রেমলিন থেকে আসা বিষাক্ত প্রোপাগান্ডা ব্যাপকভাবে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশনে প্রচার ও জনসাধারণের মগজধোলাই। দুই, নির্বাচনের আগে কল্যাণ রাষ্ট্র ও সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির মাধ্যমে ভোট কেনা। তিন, ব্যালট বাক্স ভরে রাখা ও ভোটে কারসাজি।
ক্রেমলিন প্রশাসন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেছে। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বাধ্য বিরোধী প্রার্থীর সামনেও প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়েছে। আর প্রকৃত অবাধ্য বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও আন্দোলন কর্মীদের সেই দুই বছর আগে, ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পরপরই নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
গত মাসে রাশিয়ার কারাগারে সন্দেহজনকভাবে বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনি মারা যান। সবচেয়ে স্মরণীয় বিষয় হচ্ছে, এবারই প্রথম নির্বাচন-পরবর্তী ভাষণে নাভালনির নাম নেন পুতিন। তাঁদের মধ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। দীর্ঘ এ সময়ে পুতিন কখনোই নাভালনির নাম উচ্চারণ করেননি।
এর সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না বললেই নয়, কেন রুশরা পুতিনকে ভোট দিতে ছুটেছেন, সেই গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটি হলো, পশ্চিমাদের প্রতি রুশদের ঐতিহাসিক ভয় ও অবিশ্বাস। ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত করার প্রচেষ্টার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্রদের যে ভালো উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটি রুশদের বোঝাতে খুব কম চেষ্টা করেছে তারা। রুশরা মনে করেন, প্রতিবেশীকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত করে রাশিয়াকে একঘরে করার পাঁয়তারা চলছে।
রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা হচ্ছে, এই মনোভাবের জন্ম কয়েক দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা বিবেকহীন বিজয় উল্লাস থেকে। এটিই পুতিনের ওপর বিরাট অংশের রুশদের জৈবিক সমর্থনের কারণ। এ কারণেই আবার ইউক্রেন যুদ্ধ যে অনিবার্য ও রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য, ক্রেমলিনের এই বয়ান অনেক রুশ বিশ্বাস করেন।
কাল্পনিক কিংবা বাস্তব যা–ই হোক না কেন, পুতিন বলছেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার অনুসমর্থন পেয়েছেন। এর মানে হচ্ছে, পুতিন ইউক্রেন সংঘাতের একটা নিষ্পত্তিমূলক অভিযানের জন্য নতুন করে সেনাবাহিনীতে লোকবল নিয়োগের অনুসমর্থন পেয়ে গেলেন। পুতিনের এই পদক্ষেপ দেশকে আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যাবে।
রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যেকার সংঘাতে কোন পক্ষের অবদান বেশি, সেটির চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, এই সংঘাতে প্রধানভাবে লাভবান হচ্ছেন পুতিন। এ কারণে পুতিনের রাজনৈতিক জীবন কয়েক দশক দীর্ঘ হয়েছে। এমনকি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করায় রাশিয়ার জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পাদিত ‘সামাজিক চুক্তি’ যখন হুমকির মুখে পড়েছিল, তখন এ বিষয়ই পুতিনের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। রুশরা মনে করছেন, তাঁদের জীবনে স্থিতিশীলতা যিনি এনে দিয়েছেন, জীবনযাত্রার মান যিনি উন্নত করে দিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্ব কোনোভাবেই যেন চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে।
এই আবেগের মাত্রাটা পরিমাপ করার সুযোগ কম হলেও এটা বলা নিরাপদ যে এই আবেগটা এখনো কাজ করে। এমনকি রাশিয়ায় যদি একটা স্বচ্ছ নির্বাচন হয়, সে ক্ষেত্রে এই আবেগের একটা ভূমিকা থাকবে।
কাল্পনিক কিংবা বাস্তব যা–ই হোক না কেন, পুতিন বলছেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার অনুসমর্থন পেয়েছেন। এর মানে হচ্ছে, পুতিন ইউক্রেন সংঘাতের একটা নিষ্পত্তিমূলক অভিযানের জন্য নতুন করে সেনাবাহিনীতে লোকবল নিয়োগের অনুসমর্থন পেয়ে গেলেন। পুতিনের এই পদক্ষেপ দেশকে আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে এটা স্ফটিক স্বচ্ছের চেয়ে বেশি স্বচ্ছ বিষয় হলো, কেন ইউক্রেনের আইনপ্রণেতারা অজনপ্রিয় সেনা নিয়োগ আইন তাঁদের আইনসভায় পাস করতে গড়িমসি করছেন। এর কারণ হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্য সহায়তা বিল আটকে দিয়েছেন।
ঘটনাচক্রে আটকে যাওয়া বিলটি যদি অনুমোদনও পায়, তারপরও বর্তমান সংকট ইঙ্গিত দিচ্ছে নভেম্বর মাসে মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট যে–ই নির্বাচিত হোক না কেন, ইউক্রেনের সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি কঠিনই থেকে যাবে।
সাম্প্রতিক জরিপ বলছে যে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি নির্বাচিত হন, তাহলে ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ বদলে যেতেও পারে, না–ও পারে। ট্রাম্প ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ অবসানের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তারপরও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে এই বিষয়ও পরিষ্কার যে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান বাইডেনের থেকে আলাদা নয়।
ইউক্রেনকে ট্রাম্প প্রশাসন মারণাস্ত্র দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছিল। তার আগে ওবামা প্রশাসন ইউক্রেনকে মারণাস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালিয়েছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প যদি নির্বাচনে জেতেন, তাহলে তার প্রভাব রাশিয়ায় ভিন্নভাবে পড়তে পারে। তাঁর ক্ষমতায় ফেরার মানে হচ্ছে, আমেরিকার সাধারণ জনগণ সার্বভৌমত্ববাদ ও স্বদেশিকতাবাদের পথ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র তখন জাতীয় স্বার্থ ও করপোরেট মূল্যবোধ রক্ষাতেই প্রাধান্য দেবে। সেটি সারা বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে ইউরোপের জন্য নতুন জমানার ইঙ্গিত।
এই নতুন বিশ্বে পুতিনকে যতটা না বখে যাওয়া নেতা হিসেবে দেখা হবে, তার চেয়ে বেশি করে নতুন বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্যারাডাইমে অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই বিবেচনায় নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচন পুতিন ও রাশিয়ার জন্য বেশি ঝুঁকির।
লিওনিদ রাগোজিন লাটভিয়ার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত