মতামত

ইরানের সঙ্গে চুক্তি: সৌদি আরব কি আগ্রাসী নীতি বদলাবে

কয়েক বছরের সংঘাতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইয়েমেনের জনগণ
ছবি : রয়টার্স

গত মাসে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতা করেছে চীন। এটি একটি মাইলফলক চুক্তি। এর মধ্য দিয়ে দুই চিরশত্রুর মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের অবসান হয়ে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

এ চুক্তির ফলে আরেকটি আশার দরজা খুলে গেছে। তা হলো ইয়েমেনে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা প্রক্সি যুদ্ধের সমাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক ৯ দেশের জোট বাহিনীর সঙ্গে ইয়েমেন ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যকার আট বছরের নৃশংস সংঘাত বন্ধে শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে। এ যুদ্ধে যে মানবীয় বিপর্যয় ঘটেছে, সেটাকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবীয় সংকট বলে অভিহিত করা হয়।

গত সপ্তাহে দুই প্রতিপক্ষ বন্দিবিনিময় করেছে। দুই পক্ষের মধ্যে স্থায়ী অস্ত্রবিরতির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে জোট বাহিনী ইয়েমেনের ওপর যে অবরোধ আরোপ করেছে, তা তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। এসব সত্ত্বেও শান্তির পথ এখনো অনেক বেশি অমসৃণ।

এখানে বড় অনিশ্চয়তা হলো, ইয়েমেন কি সব ক্ষত ভুলে বৈরিতার অবসান ঘটাতে পারবে?

খণ্ডবিখণ্ড ইয়েমেন

গত বছরের জুলাই মাসে এ নিবন্ধের একজন লেখক লিনা আদেল ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর এডেন থেকে রাজধানী সানা ভ্রমণ করেছিলেন। সেই ভ্রমণে ৪০টির বেশি চেকপয়েন্টে তাঁকে সশস্ত্র মিলিশিয়ারা থামিয়েছিল। তাঁর গাড়ির চালক, যুদ্ধ শুরুর আগে যিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন, তিনি প্রতিটি চেকপোস্টে থামার আগেই সেখানে কেন থামতে হবে, সেই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছিলেন।

চেকপোস্টের কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন। ১২ ঘণ্টার সেই সফরে গাড়ির চালকের বয়ান খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল।

বাস্তবে এ যুদ্ধ ইয়েমেনের প্রতিটি অঞ্চলে মানবিক সংকট তীব্র করে তুলেছে এবং ইয়েমেনিদের স্বপ্ন লুট করে নিয়েছে। এ প্রক্সি যুদ্ধে বিদেশিদের স্বার্থ রয়েছে, আঞ্চলিক ও স্থানীয় প্রতিযোগীরা তাতে ইন্ধন দিয়েছে। এর ফলে ইয়েমেন এখন খণ্ডবিখণ্ডিত একটি দেশ।

অনেকগুলো সশস্ত্র গ্রুপ এখন দেশজুড়ে তাদের প্রভাব তৈরিতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ২০১৪ সালে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করে নির্বাসনে পাঠায়। তারা সানার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী উৎখাত হওয়া সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সামরিক অভিযান শুরু করে।

এরপর থেকে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা মাঝেসাঝে সৌদি আরবেও হামলা চালায়।

দক্ষিণাঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে  পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলের দুটি দ্বীপে তারা সামরিকায়ন করেছে।

এদিকে পূর্ব ইয়েমেনের মাহরা অঞ্চলে সৌদি আরব ও ওমানের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে এবং তারা গোত্রীয় রাজনীতি উসকে দিয়ে চলেছে। ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় ইসলামি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত আল–ইসলাহ রাজধানীর উত্তর–পূর্বে অবস্থিত মারিব প্রদেশসহ আরও দুটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে।

ইয়েমেন বিভাজন এখানেই শেষ নয়। দক্ষিণাঞ্চলে যে মুদ্রা ব্যবহৃত হয়, সেটা রাজধানী সানায় চালু থাকা মুদ্রার চেয়ে ভিন্ন। এডেনে ঘুরতে–ফিরতেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পতাকা চোখে পড়বে। উত্তরাঞ্চলে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তিন বছর আগে নিহত ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানির ছবি দেখতে পাওয়া যাবে।

ভয়াবহ মানবীয় বিপর্যয়ের পর এ যুদ্ধের দ্বিতীয় অনিবার্য ফল হলো, ইয়েমেনের খণ্ডবিখণ্ড বাস্তবতা। সংকটের বাস্তবসম্মত সমাধানের পথে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় বাধা।

সৌদি আরব পররাষ্ট্রনীতিতে লাগাম টানবে কি?

সৌদি আরব প্রায় এক দশক ধরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অসংযম, ভুল হিসাব এবং বিদেশের মাটিতে অতর্কিতে ধ্বংস চালানোর নীতি অবলম্বন করে আসছে। সৌদি আরবের কাছে এ শান্তি প্রক্রিয়া তাই তাদের সেই পররাষ্ট্রনীতির লাগাম টেনে ধরার বড় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে।

১৯৩২ সালে সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটির কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সাবধানতা অবলম্বন করে চলেছে। আঞ্চলিক ক্ষমতায় ভারসাম্য বজায় রাখতে সৌদি আরব স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতিতে চলেছে।

এ ক্ষেত্রে রিয়াদ কখনোই আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য হম্বিতম্বি করেনি। বরং ওই অঞ্চলে যারা সেটা করেছে (কামাল আবদেল নাসেরের অধীন মিসর, সাদ্দাম হোসেনের সময় ইরাক, বিপ্লবের পর ইরান) তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রেই মনোযোগী থেকেছে সৌদি আরব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরাসরি সংঘাত এড়াতে সচেষ্ট থেকেছে সৌদি আরব। এর পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাগে আনার চন্য তেল বিক্রির সম্পদ, কূটনৈতিক প্রভাব ও জোটকে ব্যবহার করেছে।

সৌদি আরবের প্রথম ছয়জন বাদশাহ এ পথই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ২০১৫ সালে সৌদি আরবের সেই অবস্থানের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। সে বছর বর্তমান বাদশাহ সালমান সিংহাসনে বসেন। তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে মনোনীত করেন এবং সৌদি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান।

ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞা এবং আত্মগরিমার জন্য খ্যাত সালমান অতীতকে বাদ দিয়ে খুব দ্রুত নতুন ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন।

নতুন এ আগ্রাসী নীতির আলোকে ২০১৫ সালে ইয়েমেনে আগ্রাসন শুরু করে সৌদি আরব। সেটা ছিল এযাবৎকালের মধ্যে বিদেশের মাটিতে সৌদি আরবের প্রথম সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। সংক্ষেপে এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সৌদি আরবের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রদর্শনী।

সৌদি আরব ভেবেছিল তারা খুব দ্রুত এ আগ্রাসী অভিযান সফলভাবে শেষ করতে পারবে। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী ও অপব্যয়ী এক কানাগলিতে ঢুকে পড়ে। এ যুদ্ধ ব্যাপকভাবে সৌদি আরবের নাগরিক প্রাণ, সম্পদ ও সুনাম কেড়ে নিয়েছে। একই সঙ্গে তা ইয়েমেনের জনগণের জন্য অপরিসীম দুর্ভোগ ও মানবীয় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আট বছর পর এসে এখন সৌদি আরবের সেই যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ইয়েমেন যুদ্ধের সমাধান করতে পারলে সৌদি আরবের জন্য তা হবে তাদের স্বাভাবিক পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় পদক্ষেপ।

ইয়েমেনের জনগণের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

আট বছর ধরে ইয়েমেনের জনগণ বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, ধ্বংস, হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু দেখে আসছে।

হুতি ও সৌদি আরবের সরকার দাবি করতেই পারে যে রাজনৈতিক সমাধান প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। কিন্তু দেশটিতে এখন যে প্রচুর পরিমাণ মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, সেই গুরুতর বিষয়টি এতে থাকবে কি না, সেটা এখন বড় একটি প্রশ্ন। ইয়েমেন যেভাবে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে, যেভাবে–সেখানে বিভক্তি গেড়ে বসেছে, তাতে করে ইয়েমেনিদের জন্য শান্তির অভিযাত্রা একটা নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয়।

লক্ষ্যটা যদি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হয়, তাহলে সৌদি আরবকে অবশ্যই ইয়েমেনের আলোচনাকারীদের অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে, স্থায়ী অস্ত্রবিরতিতে যেতে হবে এবং অবরোধ তুলে নিতে হবে।

এটা উৎসাহব্যঞ্জক যে হুতি সৌদি শান্তি আলোচনায় ইয়েমেনের সব পক্ষের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। একটি বাস্তবসম্মত অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা এবং আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা জরুরি, যাতে করে মানবিক সহায়তার বিষয়টি আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করা যায়। সেটা করতে গেলে সব পক্ষকেই আলোচনায় থাকতে হবে।

  • লিনা আদেল অস্ট্রেলিয়ার পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি গবেষক

  • বেন রিচ কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক