যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা এত উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করেছে। আগের ডিকাপলিং (বিচ্ছিন্ন হওয়া) অবস্থান থেকে ডি-রিস্কিং (ঝুঁকিমুক্ত থাকতে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আদান-প্রদান বন্ধ করা) অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাস্তবতা হলো, বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দুই পক্ষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন এবং দুই পক্ষের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষ্য থাকতে হয়। ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য সম্ভবত স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম যেখানে খোলা রাখা হয়েছে, তখন এর সারবস্তুটা পরিষ্কার হচ্ছে না।
একটি কার্যকর সংলাপের জন্য প্রথম যে পদক্ষেপটি নেওয়া উচিত তা হলো বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও ভূকৌশল—এই তিন ধরনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া।
এই তিন প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে হলে অবশ্যই এই তিন প্রতিযোগিতা বাদ দিতে হবে এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এ তিনকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
জাতীয় নিরাপত্তার নামে বাণিজ্যনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে ভূকৌশলগত উত্তেজনা প্রশমন তো হয়ই না, অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে দুই পক্ষের লাভবান হওয়ার যে সম্ভাবনা, সেটি নষ্ট করে। ২০১০ সালে ভূখণ্ডগত বিরোধের জেরে চীন জাপানে তাদের দুষ্প্রাপ্য খনিজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির উৎপত্তিস্থল নিয়ে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানালে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় চীন। এ ধরনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ চূড়ান্ত অর্থে অকার্যকর।
যুক্তরাষ্ট্র একইভাবে চীনে তাদের অগ্রসর প্রযুক্তির মাইক্রো চিপস রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা একধরনের অর্থনৈতিক জবরদস্তি। সব অগ্রসর অর্থনীতির দেশ যদি একসঙ্গে ও চিরতরে চীনকে ঠেকানোর নীতি না নেয়, তাহলে প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘ মেয়াদে আমেরিকানদের আধিপত্য ধরে রাখার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নতুন যে ‘অন্যায্য শিল্পনীতি’ ও ‘অন্যায্য বাণিজ্য তৎপরতা’ বন্ধে চুক্তি করেছে, সেটাই বড় দেশগুলোর শিল্পনীতি যে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে, তা প্রশমনের একটি পথ হতে পারে। শিল্পনীতি কত দিনের জন্য কার্যকর থাকবে, বৈশ্বিক সমঝোতার শুরুর বিন্দুটি সেটাই হতে পারে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পনীতির ক্ষেত্রে চুক্তিতে পৌঁছাতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে প্রথমেই তাদের ভেঙে যাওয়া আস্থার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতাকে সফলভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে হলে জাতীয় নিরাপত্তাকে ‘হয় জিত, না হয় হার’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অন্য পক্ষের ওপর ভূকৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকবে এবং তাতে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে। অনিবার্যভাবেই এর ফলাফল দুই পক্ষের পরাজয়। সর্বোচ্চ সম্পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন আন্তনির্ভরতা—অ্যাডাম স্মিথের এই কৌশল একটা দেশকে কম নিরাপত্তা দেয় না।
দেশগুলোকে অবশ্যই অন্য দেশের ওপর যে জবরদস্তিমূলক তৎপরতা, তা বন্ধে সরাসরি সমঝোতার পথে যেতে হবে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ তাদের নিরাপত্তা চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। অর্থনৈতিক জবরদস্তি শেষ পর্যন্ত অকার্যকর অস্ত্র। শিল্পনীতির যেসব নেতিবাচক প্রভাব, সেটাতে আরও ইন্ধন দেয় প্রযুক্তি খাতের বিভেদমূলক প্রতিযোগিতা। প্রতিটি দেশই শিল্পনীতি প্রণয়ন করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রণয়ন করা ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট কিংবা চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্টের কথা বলা যায়। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, খুব কমসংখ্যক দেশই শেষ পর্যন্ত তাদের শিল্পনীতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে। বেশির ভাগ শিল্পনীতি শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়।
শিল্পনীতির সমস্যা হচ্ছে, এটা শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। ছোট একটা দেশের শিল্পনীতি যখন ব্যর্থ হয়, সেটা সেই দেশের অর্থনীতির ওপর আঘাত হানে। কিন্তু বড় দেশের শিল্পনীতি ব্যর্থ হলে সেটা সেই দেশ, মিত্রদেশ ও বিশ্ববাজারে গিয়ে আঘাত করে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নতুন যে ‘অন্যায্য শিল্পনীতি’ ও ‘অন্যায্য বাণিজ্য তৎপরতা’ বন্ধে চুক্তি করেছে, সেটাই বড় দেশগুলোর শিল্পনীতি যে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে, তা প্রশমনের একটি পথ হতে পারে। শিল্পনীতি কত দিনের জন্য কার্যকর থাকবে, বৈশ্বিক সমঝোতার শুরুর বিন্দুটি সেটাই হতে পারে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পনীতির ক্ষেত্রে চুক্তিতে পৌঁছাতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে প্রথমেই তাদের ভেঙে যাওয়া আস্থার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● উইং থাই উ জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্কের এশিয়া-সম্পর্কিত সহসভাপতি