নগরে মুরগি পালন, মাউসক্রন থেকে সিরাজগঞ্জ ও নিরাপদ খাদ্যের গল্প

যমুনা তীরের শহর সিরাজগঞ্জ—তার এক কোণে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মোসাম্মৎ মুনমুন বেগম। মুনমুনের বাসায় গেলে দেড় হাত বাই দুই হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটি খাঁচা দেখিয়ে জানান, এটাতে তিনি পাঁচটি মোরগ-মুরগি পালন করছেন।

সেটা আসলে খাঁচা নয়। গ্রামাঞ্চলে মুরগি পালনের খোপ। আমাদের গ্রামে এখনো আছে। বাড়িতে গেলে দেখি, রাতে ওই খোপে মুরগি এসে থাকে, দিনে আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। ফার্মে যেভাবে খাঁচায় মুরগি পালন করে, সেটিও দেখেছি। কিন্তু মুনমুন বেগম খোপের মধ্যে আটকে মুরগি পালছেন সিরাজগঞ্জ শহরে।

মুনমুন বেগমের মতে, যে কেউ এভাবে ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় অনায়াসে ৫-১০টা মুরগি পালন করতে পারেন। তাতে পরিবারের জন্য নিরাপদ ডিম-মাংসের সংস্থান হবে। বাজারে ডিমের দাম বাড়ার আগুনে পুড়বে না হাত। বেঁচে যাবে কিছু টাকা।

আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন দিন গড়িয়ে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্যের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মুনমুন বেগমের উচ্ছ্বাসভরা বর্ণনার প্রতিটি বাক্যই বিশ্বাস করার মতো।

দূর গ্রামে রেফ্রিজারেটর পৌঁছাবার আগে ডিমই ছিল হঠাৎ আসা অতিথি আপ্যায়নে গৃহস্থের প্রথম ভরসা। তখন প্রায় সব ঘরেই পালা হতো হাঁস-মুরগি। ব্যাপক নগরায়ণের যুগেও ডিম টিকে আছে গরিবের আমিষের উৎস হিসেবে। এমনকি ডিম ছাড়া চলে না মধ্যবিত্তেরও।

এই দুই সময়ের মধ্যে অনেক গ্রামবাসী শহুরে হয়েছেন, ছেড়ে দিয়েছেন হাঁস-মুরগির পালন। ফলে এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিক উদ্যোগ। সেখানে সরবরাহ লাইনে মাঝেমধ্যেই গন্ডগোল লেগে যায়। নানাজন নানা পক্ষকে দুষতে থাকে। কারণ যা হোক, মানুষকে ডিম-মুরগি কিনতে হয় উচ্চমূল্যে। সেটা নিরাপদ কি-না, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

সবশেষে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের কথাই ধরা যাক। তখন বাজার সামলাতে দুই দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। ১৫ কোটি সংখ্যাটি অনেক বড় মনে হতে পারে, কিন্তু এই ডিমে বাংলাদেশের চার দিনের চাহিদাও মিটবে না। বিষয়টাকে অন্যভাবেও বলা যায়, মুনমুন বেগমের মতো মাত্র দুই লাখ পরিবারে যদি পাঁচটি করে মুরগি পালন করা হয়। সেগুলো যদি বছরে গড়ে ১৫০টি ডিম দেয়। তাতেই সংখ্যাটি পৌঁছাবে ১৫ কোটিতে।

নগরে মুরগি পালনের আরেকটি গল্প বিশ্বে বহুল প্রচলিত। গল্পের শুরু ফ্রান্স সীমান্তে অবস্থিত বেলজিয়ামের ছোট শহর মাউসক্রনে। শহর থেকে বের হয়ে ৬০-৭০ কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে নর্থ সি। অদূরেই ডোভার প্রণালি।

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের কথা দুনিয়াজুড়ে বহুল প্রচলিত। তবে এই দুই দেশের মূল ভূখণ্ডের দূরত্ব সবচেয়ে কম এই ডোভার প্রণালিতেই। এ কারণে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের মধ্যকার উচ্চগতির রেলপথও এই জায়গা দিয়েই করা হয়েছে।

এত সবের আশপাশে থাকা ছোট্ট শহর মাউসক্রন হয়তো অনেকের নজরেই পড়বে না। ছবির মতো সুন্দর এক শহর। সেখানকার নগর কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে হঠাৎ সংবাদমাধ্যমে হইচই ফেলে দেয়। তা-ও আবার নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ৫০ জোড়া মোরগ-মুরগি বিতরণ করে।

বিবিসিসহ দুনিয়ার অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ৫০ জোড়া মোরগ-মুরগিকে নিয়ে কেন হইচই—সেটি নিয়ে আমিও প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। তারা মুরগি বিতরণ করেছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে।

ঘটনা হচ্ছে, বাসায় প্রায়ই খাদ্যের একটি অংশ অপচয় হয় বা খাদ্যের উচ্ছিষ্ট তৈরি হয়। এগুলো ঘরের ময়লার সঙ্গে গিয়ে ভারী করে নগর কর্তৃপক্ষের আবর্জনার বোঝা। অথচ এটিকে ময়লা হিসেবে বিবেচনা না করে অনায়াসে উৎসস্থলেই আরেকটি প্রাণীর খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যে প্রাণী আবার জোগান দেবে মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য। তৈরি হবে প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর একটি চক্র। এই চিন্তা থেকে মাউসক্রন নগর কর্তৃপক্ষ নেয় অভিনব ওই উদ্যোগ।

শহরের বাড়িতে মুরগি পালনের এই যুক্তি কি কিছুটা হলেও পরিচিত মনে হচ্ছে? এই কথাগুলোই যেন বলতে চেয়েছিলেন মুনমুন বেগম। সিরাজগঞ্জের জলবায়ু উদ্বাস্তু মুনমুন বেগম।

মাউসক্রনের এই উদ্যোগ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। নানা দেশে নেওয়া হয় উদ্যোগ। ইউরোপ থেকে বের হয়ে আটলান্টিকের ওপারের দেশ কানাডার কথাই ধরা যাক। দেশটির শত বছর পুরোনো ম্যাগাজিন ম্যাকলিনস বলছে, এক দশক ধরে নগরে মুরগি পালনের ধারণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে কানাডার বিভিন্ন শহরের কর্তৃপক্ষ।

মুনমুন বেগমের বাসার অদূরে যমুনার তীর। সেখানে হাঁটার ভালো রাস্তাও আছে। সেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আজ একজন সত্যিকারের নায়িকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে মুনমুন বেগম কেবল নিজের পরিবারের জন্য ডিম-মাংস উৎপাদন করতে চান না। ধীরে ধীরে বাড়াতে চান তাঁর পরিসর। সেটিকে দিতে চান খামারের আকৃতি। নিজের টাকায় নিশ্চিত করতে চান সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ। নিরাপদ খাবারের নিশ্চয়তা দিতে চান তাঁর ভবিষ্যৎ ক্রেতাদেরও। তিনি যেটা বুঝলেন, তা কি আমরা বুঝলাম?

যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে আটলান্টিকের তীরে অবস্থিত কানাডার শহর সেন্ট জন ২০১৩ সালে নগরে মুরগি পালনের কর্মসূচি শুরু করে। এর পাঁচ বছর পর পাইলট আকারে শুরু করে টরন্টো। ২০২২ সালে শুরু করে ভ্যাঙ্কুভার। বেলজিয়ামের পাশের দেশ ফ্রান্সের একটি শহরেও কিছুদিন আগে মুরগি পালন শুরু হয়েছে।

কানাডার মতো দেশে নগরে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যনিরাপত্তাকেও বিবেচনা করা হয়েছে। এটা যে খাদ্যনিরাপত্তায় অসাধারণ অবদান রাখতে পারে, সেটি অনেকে স্বীকার করছেন। অনেকে এটার পক্ষে প্রচারণাও চালাচ্ছেন।

তবে সবাই যে এটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন, বিষয়টা তেমনও নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, হাইজিন, মোরগের ডাকের শব্দদূষণের কথা বলে অনেকে এটার বিরোধিতাও করছেন। এসব যুক্তি খণ্ডনেও এগিয়ে আসছেন অনেক। শব্দদূষণ এড়াতে তাঁরা কেবল মুরগি পালনের কথা বলছেন। তাঁদের মতে, মোরগ প্রতিদিন ডাকে। মুরগি সে তুলনায় বেশ শান্তই থাকে। কেবল মাঝেমধ্যে ডিম পাড়ার পর মুরগিকে ডাকতে দেখা যায়।

২০২২ সালের গৃহগণনা অনুসারে, দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৮২ লাখ পরিবার বাস করে। তাঁরা যদি মুনমুন বেগমের মতো গড়ে সাতটি করে মুরগি পালন করেন, সেই মুরগি যদি বছরে গড়ে ১৫০টি করে ডিম দেয়, তাহলে দেশে উৎপাদিত ডিমের অর্ধেকের বেশি এখান থেকেই পাওয়া যাবে। নিজের বাচ্চাকে যে ডিম খাওয়াবেন, সেই মুরগির খাবারে কেউ বিষ দেবেন? অনেকে এমনিতেও দেবেন না। একটু বুঝিয়ে দিলে হয়তো অধিকাংশই আর দেবেন না।

তাহলে বাণিজ্যিক খামার কোথায় যাবে? তারাও থাকবে। প্রতিদিন চার কোটি ডিমের চাহিদা মানে চারজনের তিনজন প্রতিদিন ডিম খান না। তখন ঘরের মুরগির নিরাপদ ও সহজলভ্য ডিমের কারণে নতুন করে অনেকে নিয়মিত ডিম খাবেন। বাজার বড় হবে, তবে তাতে বাণিজ্যিক উৎপাদকদের অংশ কমবে। তাতে কেউ চাইলেও হঠাৎ কারসাজি করতে পারবে না।

২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৪১ সালের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যেও কিন্তু ডিম রয়েছে। ২০৩০ সালে বছরে জনপ্রতি ১৬৫টি ডিম এবং ২০৪১ সালে জনপ্রতি ২০৮টি ডিমের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কেবল নগরের মানুষ মুরগি পালন করলেই অন্য কোনো উদ্যোগ ছাড়াই এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

গ্রামের গৃহস্থবাড়ি ও বাণিজ্যিক উদ্যোগেও নিশ্চয়ই উৎপাদন বাড়বে। তা দিয়ে ২০৪১ সালের লক্ষ্যও অনেকখানি পূরণ হবে। তবে এত কিছুর পরও ডিম খাওয়ার দিক থেকে আমরা জাপান থেকে পিছিয়েই থাকব। গরিবের এই আমিষ পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ জাপানেও ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁরা এই ২০২৪ সালেও বছরে গড়ে ৩২০টি করে ডিম খাবেন। তাই বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের ভয়ের কারণ নেই। পথ বাকি অনেকখানি।

মুনমুন বেগমের বাসার অদূরে যমুনার তীর। সেখানে হাঁটার ভালো রাস্তাও আছে। সেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আজ একজন সত্যিকারের নায়িকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে মুনমুন বেগম কেবল নিজের পরিবারের জন্য ডিম-মাংস উৎপাদন করতে চান না। ধীরে ধীরে বাড়াতে চান তাঁর পরিসর। সেটিকে দিতে চান খামারের আকৃতি। নিজের টাকায় নিশ্চিত করতে চান সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ। নিরাপদ খাবারের নিশ্চয়তা দিতে চান তাঁর ভবিষ্যৎ ক্রেতাদেরও। তিনি যেটা বুঝলেন, তা কি আমরা বুঝলাম?

সেদিন দেখি, খাদ্যচক্রের নানা স্তর ব্যাখ্যা করে এক চিকিৎসক বলছেন, এই যুগের অরগানিক আসলে অরগানিক নয়। খাবার তৈরির স্তরে স্তরে রয়েছে ঝুঁকি। তাই নিরাপদ খাবার খাওয়া এই যুগে সম্ভব নয়।

আমি এখন ভাবছি, আমার আপনার জন্য অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু মুনমুন বেগমের মাঝে আমি যে আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখেছি, শিগগিরই তার পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে তার সন্তানরা পূর্ণরূপে নিরাপদ খাবারই খাবে। আমরা শহুরে বাবুরা অনেকে পড়ে থাকব ‘সম্ভব না’-এর চক্রে।

  • সুলাইমান নিলয় উন্নয়ন পেশাজীবী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক