‘হাতি হত্যা মতান্তরে হাতির মৃত্যুর তালিকা অনেক লম্বা। হাতির ‘মৃত্যু’ বন্ধের জন্য প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’
‘হাতি হত্যা মতান্তরে হাতির মৃত্যুর তালিকা অনেক লম্বা। হাতির ‘মৃত্যু’ বন্ধের জন্য প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

হাতি মরে যাচ্ছে, নাকি মারা হচ্ছে

প্রায় নিয়মিত বিরতিতে মা হাতি, হাতির বাচ্চা মারা যাচ্ছে বা মেরে ফেলা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার পর গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু থামছে না হাতি হত্যার মিছিল।

শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি গ্রামে এখন মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতি রাতেই হাতি সেখানে জড়ো হয়ে উচ্চ স্বরে ‘কান্নাকাটি’ করছে। আসলে হাতিগুলো তাদের মৃত সাথির খোঁজ করছে। সেটাই গ্রামবাসীর কাছে ‘কান্নাকাটি’ মনে হচ্ছে। মাত্র কয় দিন আগে হাতিটি সন্তান জন্ম দিয়েছিল। অভিজ্ঞতা বলে, আগামী পূর্ণিমার আগে–পরে নিখোঁজ (আসলে খুন এবং হাতিদের অগোচরে পুঁতে ফেলায় গুম) সাথির খোঁজে পাগলপ্রায় হাতির দল নিহত হাতিটির সন্ধান চালিয়ে যাবে। সন্ধান করতে থাকবে গুমঘর বা আধুনিক আয়নাঘরের!

হাতি হত্যা মতান্তরে হাতির মৃত্যুর তালিকা অনেক লম্বা। হাতির ‘মৃত্যু’ বন্ধের জন্য প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন

গত ৩১ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে গ্রামবাসীর পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ফাঁদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সদ্য মা হওয়া হাতিটি। সেই রাতে অন্যান্য হাতি না পালিয়ে সারা রাত হাতিটিকে ঘিরে রাখে আর ডাকতে থাকে। খবর পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও হাতিগুলো নড়েনি। বনবাবুরা শেষ পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ফাঁদের প্রাণভোমরা জেনারেটরটা জব্দ করে তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন। পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে নিথর হাতিটি রেখে অন্য হাতিগুলো জঙ্গলে ফিরে যায়। মনে রাখা দরকার, হাতি হচ্ছে যূথবদ্ধ ও পরিবারকেন্দ্রিক প্রাণী। এদের এক সদস্যের মৃত্যু তার পরিবারের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে।

বৈদ্যুতিক ফাঁদে হাতি হত্যার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এই সিলসিলা অনেক দিনের। ২০২৪ সালের ১৬ আগস্ট টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নোয়াখালীপাড়ার কোনারপাড়া এলাকায় একইভাবে মারা হয় অন্য একটি হাতি। নিহত হাতিটির বয়স ছিল ২৫ থেকে ৩০ বছর। এক বছর আগে, ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের পানেরছড়া এলাকায় ‘বৈদ্যুতিক ফাঁদে’ আটকে মারা যায় আরেকটি হাতি।

সম্প্রতি ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে মারা যায় একটি হাতির বাচ্চা। অভিযোগ আছে অবহেলা আর ভুল চিকিৎসার। আহত হাতিটি দুর্ঘটনাস্থল চুনতি থেকে ডুলাহাজারার প্রাণী চিকিৎসা হাসপাতালে নিতে ৪৮ ঘণ্টা সময় লেগেছিল! ১৩ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটার দিকে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে ছয় হাতির একটা দলকে ধাক্কা দেয়। জোছনারাতে হাতির এই দল তখন তথাকথিত এলিফ্যান্ট ওভারপাসের (রেললাইনের ওপর দিয়ে হাতি পারাপারের পথ) কাছে ছিল। ওভারপাসের উত্তর পাশে ট্রেনের ধাক্কায় হাতিটির পেছনের ডান পা ভেঙে যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে এই মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত।

জোছনারাতে বেশি সাবধান হতে হবে

মানুষের যেমন জোছনাস্নানের শখ হয়, বনের প্রাণীদের তেমন ইচ্ছা করে। লোকালয়ের প্রাণী, বিশেষ করে সারমেয়দের জোছনা–চাঞ্চল্য প্রাণিপ্রেমিকমাত্রই লক্ষ করে থাকবেন। জোছনার আলোয় খাবারের সন্ধানে বন্য প্রাণীগুলো বের হয়, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আর চালতার সময় চালতার গন্ধে তারা লোকালয়ের কাছে একটু বেশি আসে, পাকা ধানের গন্ধও তাদের আকর্ষিত করে।

এলিফ্যান্ট ওভারপাসের কাছে হাতির দলকে ধাক্কা দেওয়ার অপরাধে ট্রেনচালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। হাতিটি মারা যাওয়ার পর একটা কিছু ‘অ্যাকশন’ দেখানোর চাপ থেকে এ রকমটি করা হতে পারে। যেসব বনে হাতির চলাফেরা আছে, তার বুক চিড়ে বসানো হয়েছে রেললাইন, সেখানে হাতির মনমানসিকতা চলাফেরার নিয়মনীতি জোছনা–অমাবস্যায় প্রাণীদের গতিবিধির রকমফের নিয়ে রেলে কি কোনো চর্চা আছে? ট্রেনচালকদের প্রশিক্ষণে কি এসব নিয়ে কেউ আলোচনা করেন? আর প্রতি শুক্লপক্ষে তাঁদের সেগুলো মনে করিয়ে দেওয়া হয় কি? আমরা কি জানি, হাতি সন্তান প্রসবের সময় সমতলে চলে আসে দলবল নিয়ে। আমাদের বনবাবুরা কি সেদিকে সজাগ থাকেন? কারণ, লোকালয়ে আসা একের পর এক বুনো হাতি বিষক্রিয়াতেও মরছে। এই বিষক্রিয়ার কারণ কি বের করেছে বন বিভাগ?

আন্ডারপাসে ত্রুটি নেই তো?

হাতি হত্যা মতান্তরে হাতির মৃত্যুর তালিকা অনেক লম্বা। হাতির ‘মৃত্যু’ বন্ধের জন্য প্রতিটি ঘটনার চুলচেরা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, রেলপথের কথিত বাইপাস কি হাতিবান্ধব হয়েছে, না দায়সারা নিয়ম রক্ষা হয়েছে মাত্র। খালি চোখে দেখলেই বোঝা যায়, সরু আন্ডারপাস দিয়ে হাতি যেতে পারবে না। আদতে হয়েছেও তা–ই, সরু আন্ডারপাস হাতির দল ব্যবহার করছে না।

সবাই জানে, ২০১২ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের শুরুতে চুনতি, ফাসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর রেলপথ নির্মাণের বন বিভাগের মত ছিল না। বন্য প্রাণীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করার মৌখিক আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। পরে দুই সংস্থার সঙ্গে হওয়া চুক্তি ও গেজেট অনুযায়ী দাবি মেনে নিতে বারবার তাগাদা দেয় বন বিভাগ। কিন্তু সেসব কানে নেয়নি রেলওয়ের প্রকল্প বিভাগ। বর্তমানে দৈনিক তিন জোড়া ট্রেন চলছে। পুরোদমে চালু হলে ট্রেন চলবে প্রায় ২৩ জোড়া। তখন হাতিসহ বন্য প্রাণীর ঝুঁকি আরও বাড়বে। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি অন্তর দিয়ে ভেবে দেখতে পারে।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

    wahragawher@gmail.com