কল্পনা চাকমা
কল্পনা চাকমা

কল্পনা চাকমা তাহলে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন

২৩ এপ্রিল কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটির আদালতে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। এ আদেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে চলা মামলাটির যবনিকাপাত ঘটানো হলো। এ দীর্ঘসূত্রতার ধরন থেকে আমাদের এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটির পরিণতি শেষ পর্যন্ত এমন কিছুই হবে।

মামলা খারিজের মাধ্যমে এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একপ্রকার দায়মুক্তি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক নতুন নজির তৈরি হলো। তাই বহুল আলোচিত এ অপহরণ মামলার পরিণতি থেকে আমাদের এই শিক্ষা নিতে হবে যে পাহাড়ে বিচারের বাণীকে আর নীরবে কাঁদতে দেওয়া যাবে না। কল্পনা চাকমা যত দিন রাজপথে ছিলেন, তত দিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের কল্পনাদেরও সেভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।

পরিবারের সদস্যদের সামনে থেকে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাতের মধ্যে হাওয়া করে দিল, অথচ ২৮ বছরেও রাষ্ট্র সেই সব অপহরণকারীকে চিহ্নিত করতে পারল না! এ লজ্জা আর ব্যর্থতার দায় কার?

কল্পনা অপহরণ মামলার তদন্তকাজ বছরের পর বছর ধরে যে প্রহসনের ভেতর দিয়ে গেল, তাতে আরও একবার প্রমাণিত হলো যে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের ছোট ছোট জাতিসত্তার মানুষদের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে কল্পনা চাকমাকে তাঁর নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, কল্পনাকে সেই রাতে শৃঙ্খলা বাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদধারী একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং এ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা তাঁর জবানবন্দিতেও সেই একই অভিযোগ বারবার উত্থাপন করেছেন।

কিন্তু কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি ৩৯ জন কর্মকর্তা তদন্ত করলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে সব তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযুক্ত এই সন্দেহভাজনদের বিষয়টিকে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তাঁদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমা অপহৃত হওয়ার দীর্ঘ ১৪ বছর পর বাঘাইছড়ি থানার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক ২০১০ সালের ২১ মে রাঙামাটির আদালতে প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

কল্পনার মামলাটি পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন ও নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি প্রতীক। সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি মশালের নাম কল্পনা। যদিও-বা দীর্ঘ লড়াইয়ের পরও কল্পনা নিজেই পাহাড়ের এ বিচারহীনতা সংস্কৃতির কালো থাবার বলি হলেন। কিন্তু নিজেকে উৎসর্গ করে পাহাড় ও সমতলের নারীদের রুখে দাঁড়ানোর যে পথ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সেই পথেই পাহাড়ি নারীর মুক্তির পথ মিলবে একদিন।

মামলাটি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যে প্রবল গড়িমসি ভাব এবং দায়সারা রুটিন তদন্ত ছাড়া প্রকৃত অনুসন্ধানী কোনো তদন্ত পরিচালিত হয়েছে বলে কল্পনার পরিবার ও তাঁর সহযোদ্ধারা মনে করেন না। তা না হলে এত জন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করার পরও একই ধরনের প্রতিবেদন কেন বারবার উঠে আসবে! প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনে কে বা কারা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছে, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

তাহলে কি আমাদের এ কথা বিশ্বাস করতে হবে যে সেই রাতে বাঘাইছড়ির নিউলাল্যঘোনায় অলৌকিক এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যার জাদুবলে কল্পনা চাকমা রাতের আঁধারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন!

প্রতিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কল্পনার অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি, বা কারা অপহরণ করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি—উল্লেখ থাকায় বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা সেসব তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন করেছেন।

সর্বশেষ ২০১৬ সালে মামলার ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে রাঙামাটির পুলিশ সুপার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথভাবে নির্দেশনা প্রতিপালন না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করায় বাদী আবারও সেই প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন জানান। দীর্ঘ প্রায় আট বছর বিচারাধীন রেখে অবশেষে ২৩ এপ্রিল নারাজি আবেদনটি খারিজ করে দিয়ে আদালত মামলাটিকে নথিভুক্ত করেন।

এ ছাড়া কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদে বাঘাইছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে গুলিতে আহত স্কুলছাত্র রূপন চাকমা, মনতোষ চাকমা, সুকেশ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমাকে গুম করার ঘটনারও কোনো বিচার আজও হয়নি।

কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি এমন একটি আলোচিত মামলা, যেটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সে সময় কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে দেশে-বিদেশে জোরালো জনমত গড়ে উঠেছিল।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’–এর  প্রতিনিধিদের হেলিকপ্টারে করে বাঘাইছড়ি পাঠায়। মানবাধিকার কমিশনের ওই প্রতিনিধিদল কল্পনাদের বাড়িতে গিয়ে বাংলা বলতে না পারা কল্পনার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। পরে ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে তারা কল্পনার মায়ের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। এর মধ্য দিয়ে অপহরণ ঘটনাটিকে স্পষ্টতই অন্য খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলাটিকে অতলে হারিয়ে যেতে দেয়নি কল্পনার পরিবার, তাঁর সহযোদ্ধা ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। 

অদৃশ্য শক্তির চাপে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপহরণ মামলা থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার পথ সুগম করতে আজ হয়তোবা মামলাটি খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কল্পনার পরিবার ও তাঁর সহযোদ্ধারা মনে করেন, দেশে যদি প্রকৃত সুবিচার থেকে থাকে, তাহলে উচ্চ আদালতে অবশ্যই তাঁরা এ ঘৃণ্যতম অপরাধের সুবিচার পাবেন।

কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি নিছক কোনো মামুলি মামলা নয়। মামলাটি পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন ও নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি প্রতীক। সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটি মশালের নাম কল্পনা। যদিও-বা দীর্ঘ লড়াইয়ের পরও কল্পনা নিজেই পাহাড়ের এ বিচারহীনতা সংস্কৃতির কালো থাবার বলি হলেন। কিন্তু নিজেকে উৎসর্গ করে পাহাড় ও সমতলের নারীদের রুখে দাঁড়ানোর যে পথ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সেই পথেই পাহাড়ি নারীর মুক্তির পথ মিলবে একদিন।

ইলিরা দেওয়ান কল্পনা চাকমার সহযোদ্ধা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক