দেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণার অন্যতম বাধা প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করে প্রস্তাবমূলক এ লেখা লিখেছেন সৌমিত জয়দ্বীপ। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষা নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক লেখার এটি তৃতীয় পর্ব
উৎস ভিন্ন হলেও, ইংরেজি ‘প্রফেসাই’ (গ্রিক) ও ‘প্রফেস’ (লাতিন) ক্রিয়াপদ দুটির গূঢ় আন্তযোগ আছে। প্রফেসাই (ভবিষ্যবচন) করেন প্রফেট বা নতুন তত্ত্বের প্রবক্তা। যিনি প্রফেস বা জনসমক্ষে অনুভূতিজ্ঞাপন করেন তিনি প্রফেসর বা প্রবক্তা। সমকালীন অর্থে এই প্রবক্তা শুধু জ্ঞানদানকারীই নন, তারও অধিক; গবেষণার মাধ্যমে অভূতপূর্ব-জ্ঞান উৎপাদনকারী এবং জনসমক্ষে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশকারী। সর্বজনীনভাবে, প্রফেসরের বাংলা অধ্যাপক—যিনি অধ্যাপনা করেন বা অধ্যয়নরতকে পড়ান। তবে অধ্যাপককে আমরা প্রবক্তার সমানই বিবেচনা করি।
অধ্যাপক কিংবা প্রবক্তার ‘বাংলাদেশি সংস্করণ’
প্রত্যন্ত বাংলাদেশে মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকমাত্রই ‘প্রফেস্যার’ হিসেবে লোকমুখে সমাদৃত। শিক্ষকেরাও এমন পরিচয় দিতে বা পেতে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে গৌরব বোধ করেন, যার আদতে ভিত্তিমূলক কোনো মেরিটই নেই! কিন্তু প্রকৃতার্থেই যাঁরা ‘অধ্যাপক’ পদে আসীন হয়েছেন, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাঁরা কি এই গুরুভার বহনের যোগ্য? তাঁরা কি আদতেই প্রবক্তা হয়ে ওঠেন?
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার নয়া-বয়ান নেই। নেই স্বায়ত্তশাসনের নির্বাহী-রূপ, যার সঙ্গে তাত্ত্বিকভাবেই প্রবক্তা সত্তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। বরং নির্বাহী-দাসত্বের বদৌলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে ‘সরকারদলীয় শাখা কার্যালয়ে’ পরিণত হয়েছে। এসবের দায়ভার এই তথাকথিত অধ্যাপকদেরই, যাঁরা প্রবক্তা হওয়া তো দূরের কথা, শিক্ষক হওয়ারই যোগ্য নন সিংহভাগ!
বাজারব্যবস্থার দাসস্বরূপ এ পেশাটিকে ‘শিক্ষকতা’ নয়, তাঁরা ‘চাকরি’ হিসেবেই নিয়েছেন। এরপর কেউ হয়েছেন ভোটার, কেউ দলদাস সভাসদ-প্রার্থী, কেউ দলীয় তাঁবেদার অযোগ্য উপাচার্যসহ বিবিধ ক্ষমতালিপ্সু পার্ষদ। এভাবেই ভোটাভুটি ও দলবাজির আনন্দে আস্ত একটা ‘শিক্ষকতা’ জীবন পার করেন তাঁরা।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে কয়েক ধাপে পদোত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা অধ্যাপকের ‘বাংলাদেশি সংস্করণ’ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সিংহভাগই আর প্রবক্তা হননি। তাঁদের ‘প্রফেস্যার’ বলবেন? বলবেন গবেষক!
মূলে অত্যাশ্চর্যজনক নিয়োগপ্রক্রিয়া
উল্লিখিত নানা কারণে, বিরল ব্যতিক্রম বাদে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষকরা’ আর জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে গণ্য হন না। জনগণের আস্থা তাঁরা খুইয়েছেন। শিক্ষকেরা আবার মনে করেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে’ তাঁদের পদমর্যাদা ঠিক উচ্চপদস্থ আমলাদের সমানুপাতিক নয়। কিন্তু অতীতে আন্দোলন করলেও পদমর্যাদার খুব উল্লম্ফনও তাঁদের ঘটেনি।
রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম নির্ধারক আমলারা কেনই-বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তাঁদের সমানুপাতিক হতে দেবেন? বিসিএস নিয়ে বহু সমালোচনা করা হয়েছে-হচ্ছে-হবে। কিন্তু ‘রাজসেবকত্ব’ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় যতগুলো ‘পরিশ্রমলব্ধ’ পরীক্ষা-ধাপ তাঁদের উতরাতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে তা হয়?
এই রাষ্ট্রে সবচেয়ে সহজলব্ধ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাগে একটা সানুগ্রহ মানওয়ালা ফল, একটা দুর্দমনীয় লবিং আর একটা ‘প্রার্থী-হাজির’ মৌখিক পরীক্ষা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নামকাওয়াস্তে লিখিত পরীক্ষা।
ব্যতিক্রম বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তরে ‘উচ্চমার্গীয়’ ভালো ফলের জন্য নির্বাচিত শিক্ষকবর্গের সঙ্গে খয়ের খাঁবাজি এবং ভালো লবিংবাজ প্রমাণে লাগে ক্ষমতাবানের সুপারিশ (ক্ষেত্রবিশেষে উৎকোচ)। তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষায় সব এমনিতেই কীভাবে যেন ‘ভালো’ হয়ে যায়! কী অত্যাশ্চর্য এ নিয়োগপ্রক্রিয়া!
বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়াটির প্রবর্তক তৎকালীন পূর্ববঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয়-ইতিহাসের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। সেটির প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে, রালেইঘ কমিশন (১৯০২), নাথান কমিটি (১৯১২) ও স্যাডলার কমিশনের (১৯১৭-১৯১৯) সুপারিশকে বিবেচনায় নিতে হবে।
রালেইঘ কমিশন, নাথান কমিটি ও স্যাডলার কমিশন যা বলেছিল
উনিশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে আধুনিক ‘গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে’র পত্তন হলেও, ভারতবর্ষে তদ্বিষয়ক প্রাসঙ্গিক আলাপ ব্রিটিশরা তোলেইনি। বরং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেডারেল মডেলে ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম তিনটি ঔপনিবেশিক বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ) হয়ে গেল পরীক্ষাগ্রহীতা ও সনদদাতা (এফিলিয়েটিং)। পরের দুটির মধ্যে পাঞ্জাব (১৮৮২) পঠনপাঠন (টিচিং) ও সনদদাতা এবং এলাহাবাদ (১৮৮৭) শুধুই পঠনপাঠন বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ শতকের শুরুতে লর্ড কার্জনের ‘আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র আকাঙ্ক্ষা পূরণে রালেইঘ কমিশন (ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন) পরীক্ষাকেন্দ্রিক সনদদাতা বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থার কড়া সমালোচনাপূর্বক পঠনপাঠনকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে জোরালো সওয়াল করে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্নাতকোত্তর ও অধিভুক্ত কলেজকে স্নাতক পড়ানোর প্রস্তাব রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বউদ্যোগে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে।
১৯১৩ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে উদ্ভব ঘটে আরেকটি নতুন মডেলের-‘পঠনপাঠন ও আবাসিক’ বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ মডেলের প্রথম দৃষ্টান্ত বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (১৯১৫)। ব্রিটিশরাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মডেলটির রূপ আরেকটু বর্ধিত হয়-‘ইউনিটারি টিচিং অ্যান্ড রেসিডেন্সিয়াল’।
মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে নাথান কমিটি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি) এবং স্যাডলার কমিশন (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন) উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই মডেল সুপারিশ করে পরোক্ষে ফেডারেল মডেলকে নাকচ করেছিল। এ সুপারিশ বিপ্লবাত্মক হলেও, কালের পরিক্রমায় অনস্বীকার্য যে পূর্ববঙ্গের প্রথম উচ্চবিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল আপাত ভুল প্রক্রিয়ায়।
প্রথমত, খুব অনায়াসেই ঢাকা কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রয়োজনে (যেমন: শিক্ষক-সেবা, গ্রন্থাগার-সেবা ইত্যাদি) এই কলেজের সহায়তাও উপাচার্য পি জে হার্টগ নিয়েছিলেন। সহায়তাই যদি নিতে হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা যেত। উল্টো উপনিবেশের ‘চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো।
দ্বিতীয়ত, নাথান কমিটিকে নিয়োগকালে সরকার নির্দেশনা দিয়েছিল শুধু ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টির রূপরেখা তৈরি করতে, যা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে এই ধারার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ঢাকা শহরের তদানীন্তন চারটি কলেজকে (ঢাকা, জগন্নাথ, আইন ও শিক্ষক কলেজ) ‘নিউক্লিয়াস’ ধরে নতুন প্রতিষ্ঠিতব্য সাতটিসহ মোট ১১টি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলনে গড়ে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মানে সরাসরি না বলা হলেও, চরিত্রটি ‘পঠনপাঠনে’র মোড়কে ‘সনদদাতা’ বিশ্ববিদ্যালয়েরই হয়ে উঠল।
আইন প্রণালির গুরুগাম্ভীর্যের ভিড়ে এ সূক্ষ্ম বিষয়টি দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল। ফলে খোদ হার্টগসহ ভবিষ্যতের কর্ণধারেরাও সমস্যাটি উতরাতে পারেননি। উত্তরকালে সংকট আরও নীরবে ঘনীভূত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার পরিপূর্ণ আবাসিক চরিত্র হারিয়ে ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়েই রূপান্তরিত হয়েছিল।
স্যার হার্টগ কী চেয়েছিলেন, কী হলো
মৌখিক পরীক্ষার প্রক্রিয়াতেই সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে স্যার হার্টগ নিয়োগ দিয়েছিলেন অসাধারণ সব শিক্ষক এবং বস্তুত চাইছিলেন, এই শিক্ষকমণ্ডলী স্বাধীনভাবে বিশ্বমানের গবেষণা করবেন। হার্টগের প্রত্যাশা ও শিক্ষকদের প্রতি সমর্থনটা ছিল সৎ ও প্রশংসনীয়। কিন্তু মস্ত বড় শিক্ষাবিদ হার্টগও সম্ভবত বুঝতে পারেননি, যে মডেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হলো, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, সেটাতে গবেষক হিসেবে প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠার সুযোগ অনেক কম। হার্টগের আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে পথটা ঠিক ছিল না।
পঠনপাঠনকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষাই মুখ্য হয়ে উঠল। কাঠামোগত ত্রুটির কারণেই গবেষণা হয়ে থাকল গৌণ। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ল। শিক্ষকদের ওপরও চাপ বাড়ল। শিক্ষকেরা শিক্ষকই রয়ে গেলেন। সময়ের নিয়মে অধ্যাপক হলেন বটে, কিন্তু প্রবক্তা হতে পারলেন কমজনই!
ইউজিসি ও ঢাবির নয়া ভাবনা, তবু প্রয়োজন সংস্কার
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ার বড় দুর্বলতা-সদ্য স্নাতকোত্তর পাসকারী হঠাৎ নবিশ প্রভাষক হয়ে যান, যা বৈশ্বিক বিদ্যায়তনিক পরিসরে অচিন্তনীয়! বহির্বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে প্রাধান্য পায় প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রি ও গবেষণাক্ষেত্রে অবদান। আর বাংলাদেশে পায় এসএসসি-এইচএসসিসহ ‘ফোর্থ ফার্স্টক্লাসে’র ডগমা।
২০২১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এসএসসি-এইচএসসির ফলাফল ব্যতিরেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নয়নের যুগোপযোগী নীতিমালা’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রেরণ করেছিল। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশভুক্ত স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রসঙ্গ আলাদা, কিন্তু ‘সরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নীতিমালাটি মানেনি। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডিহীনদের বিবেচনা না করার নীতিগত আলোচনা শুরু করেছিল, যা গবেষক-শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ভাবনা।
অবশ্য ‘উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষার নয়া ইশতেহারে’ প্রস্তাবিত ‘টেক্সোনমি অব হায়ার এডুকেশন’ বাস্তবায়িত হলে পিএইচডি ছাড়া কারও শিক্ষক হওয়ার সুযোগই থাকবে না। তবু শিক্ষক নিয়োগের চলমান প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাটি ভেঙে প্রার্থিতার যোগ্যতা ও নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিপুল সংস্কার (রিফর্মেশন) করা বাঞ্ছনীয়।
মূল যোগ্যতা পিএইচডি ও নিয়োগের অন্যান্য রূপরেখা
নিয়োগে প্রার্থিতার একমাত্র মানদণ্ড হবে-স্বীকৃত দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং অন্তত দুটি গবেষণা প্রবন্ধ ও দুটি কনফারেন্স পেপার। কিউ-১ /কিউ-২ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ চূড়ান্ত ফলাফলে বেশি ওজনদার পয়েন্ট পাবে।
এসএসসি-এইচএসসির ফলাফল নয়, বিবেচ্য হবে শুধু স্নাতক-স্নাতকোত্তরের ফলাফল। সেটিও প্রার্থিতার মানদণ্ড হিসেবে নয়, শুধু নির্দিষ্ট পয়েন্ট হিসেবে, যা চূড়ান্ত ফলাফলে অপরাপর মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত হবে। পিএইচডি, গবেষণা প্রবন্ধ, কনফারেন্স পেপার, স্নাতক-স্নাতকোত্তরের ফলাফল এবং নিয়োগ পরীক্ষার চারটি ধাপের পয়েন্ট মিলিয়ে একটি সমন্বিত স্কোরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে চার ধাপের রূপরেখাটি এমন: নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা> লিখিত পরীক্ষা> প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক পরীক্ষা> মৌখিক পরীক্ষা।
নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষাটি হবে সাধারণ শিক্ষা ও বিষয়ভিত্তিক। লিখিত পরীক্ষাটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণমূলক। প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক পরীক্ষাটি হবে গবেষণাকে কেন্দ্র করে কয়েক দিনব্যাপী কর্মশালা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম মডেলে, যার শেষাংশে প্রার্থী একটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। সবশেষে অনুষ্ঠিত হবে মৌখিক পরীক্ষা। নিয়োগ পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ তিন মাসে সম্পন্ন হবে।
এই প্রক্রিয়ায় একজন প্রার্থী প্রভাষক বা জ্যেষ্ঠ প্রভাষক নন, সরাসরি সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাবেন। দুনিয়াব্যাপী, এমনকি বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও, পিএইচডিধারীরা সহকারী অধ্যাপক পদেই বিবেচিত হন।
নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ হিসেবে উচ্চশিক্ষা কমিশন
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) যেমন বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, তেমনি ইউজিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগদাতা হিসেবে কেউ কেউ ভাবতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ হিসেবে একটি ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ গঠনই হবে যুক্তিযুক্ত। মোদ্দাকথা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে না।
কমিশন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগভিত্তিক শিক্ষক চাহিদার সমষ্টিকে বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞপ্তি দেবে। নিয়োগ পরীক্ষার প্রক্রিয়া শেষে প্রাপ্ত মেধাক্রমের ভিত্তিতে নির্বাচিতদের প্রদত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দ-ক্রমানুযায়ী বিজ্ঞপ্তিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেবে।
পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াকে ‘মাল্টিপল ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ’ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। ফলে ন্যূনতম স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, দলীয়করণ ও বিশ্ববিদ্যালয়প্রীতির সুযোগ থাকবে না। অতিস্বচ্ছতার জন্য নিয়োগপ্রক্রিয়ার যেকোনো ধাপে বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরও সংযুক্ত করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সংশয় ও শেষ কথা
উচ্চশিক্ষা কমিশন নিয়োগকর্তা হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সংশয়ে পড়ার ঝুঁকি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ উচ্চপদস্থদের সরকারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিলে স্বায়ত্তশাসন ঝুঁকিতে পড়ে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অটুট রাখার দায়িত্ব খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের, যেটি তারা আজ পারছে না।
কমিশনের দায়িত্ব যোগ্যদের শুধু নিয়োগদান। এরপর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ও বিধিমালার বলে প্রাপ্য সুবিধাদি ভোগ করবেন। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ও আইন পুনর্লিখন করতে হবে। মোদ্দাকথা, এমন সুরক্ষাব্যবস্থা বানাতে হবে, যেন শিক্ষকের বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতায় কোনো শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
বাজারের চাপে-তাপে বাংলাদেশে আজ গবেষক-প্রবক্তাদের যে অভাব ও দুরবস্থা, তা দূরীকরণে এমন সর্বপ্লাবী রিফর্মেশন ছাড়া গত্যন্তর আছে?
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়