সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা কেন প্রকৃত সংস্কার

চেয়ার থেকে মন্দ লোকটিকে তুলে দিয়ে একজন ভালো লোককে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। এটা সংস্কার নয়। তাহলে কোনো একদিন একজন মন্দ লোক এসে সুযোগ বুঝে চেয়ারে বসে পড়বে, তখন আবার একটা দানব তৈরি হবে, আবার একটা ফ্যাসিস্ট তৈরি হবে।

সংস্কার হলো চেয়ারটাকে এমনভাবে পুনর্নির্মাণ করা, যাতে মন্দ লোকেরা নতুন চেয়ারটিতে বসতেই না পারে।

প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থার বদলে সংখ্যানুপাতিক ভোটের প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনব্যবস্থা হলে কেমন হয়? এই বিতর্ক উঠেছে।

আনুপাতিক ভোটের নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে পৃথিবীর ৯৯টি দেশ। এটিকেই সবচেয়ে আধুনিক এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মনে করা হয়। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ভোট মূল্যায়িত হয়।

বিজ্ঞজনেরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। কমিউনিস্ট পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু ইসলামিক দল, জাতীয় পার্টি এই পদ্ধতির পক্ষে।

যত দূর জানি, বিএনপিসহ কয়েকটি দল এই পদ্ধতির পক্ষে না। এই পদ্ধতিতে ছোট দলগুলো বেশি লাভবান হবে, মোট গৃহীত ভোটের ৫১ শতাংশ ভোট না পেলে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা বিএনপির পছন্দ না হওয়ারই কথা।

অন্যদিকে এ মুহূর্তে প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে যেতেও পারে, অনেকে মনে করছেন হয়তো ১০–১২টি আসনের বেশি পাবে না। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক ভোটের নির্বাচন হলে ওরা যদি ১৫ শতাংশ ভোটও পায়, তাহলে ৪৫টি আসন পেয়ে যাবে।

এসব বিবেচনা করে অনেকেই এ ব্যবস্থার বিপক্ষে। কেউ কেউ অতীতের ভোটের হিসাবও করছেন। সেই হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়ও এসে যেতে পারে। কারণ, অতীতের ভালো নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই গৃহীত ভোটের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের আশপাশে ভোট পেয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেলেও মোট ভোট পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ এবং বিএনপি মাত্র ৩০টি আসনে জয়লাভ করলেও মোট ভোট পেয়েছিল ৩০.২০ শতাংশ।

যদি সেই নির্বাচনটি সংখ্যানুপাতিক ভোটের নির্বাচন হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ পেত ১৪৭টি আসন এবং বিএনপি পেত ৯০টি আসন। এখানেই পার্থক্যটা।

যেহেতু পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ এই আনুপাতিক ভোটের নির্বাচন বা প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি অনুসরণ করে সুফল পেয়েছে, পাচ্ছে এবং এটিকেই সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র বলা হচ্ছে, নিরীক্ষার খুব একটা ঝুঁকি আমাদের নিতে হচ্ছে না।

এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০০টি আসনে জয়লাভ করেছিল, প্রায় সমানসংখ্যক, ৪০.০২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল মাত্র ৬২টি আসন। অথচ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হলে বিএনপি পেত ১২৩টি আসন আর আওয়ামী লীগ পেত ১২০টি আসন।

অতীতে যেহেতু কোনো দলই ৫১ শতাংশ ভোট পায়নি, তাই অনেকেই ধরে নিচ্ছেন এই পদ্ধতিতে কেউই এককভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারবে না। কিন্তু তাঁরা এটা ভাবছেন না, নতুন ব্যবস্থায় ভোটের হিসাব পাল্টেও যেতে পারে।

এখন প্রার্থীরা নিজের নির্বাচনী এলাকায় নিজের জয়ের জন্য কাজ করেন, তখন সারা দেশে তাঁরা দলের জয়ের জন্য কাজ করবেন। নির্বাচনের আগে অন্য দলের সঙ্গে ভোটের ঐক্য হতে পারে। নির্বাচনের পরে সরকার গঠনের ঐক্যও হতে পারে।

প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন তো আমরা অনেক তো দেখলাম, এবার নতুন ব্যবস্থায় দেখি না কী হয়। একটা বিষয় নিশ্চিত করেই বলা যায়, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত পার্লামেন্টে একটা ইতিবাচক ভারসাম্য থাকবে, যা সরকারেও প্রতিফলিত হবে।

চাইলেই হুটহাট নিজেদের সুবিধার জন্য যা খুশি আইন পাস করে ফেলতে পারবে না কোনো দল। এ ব্যবস্থায় কোনো সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার আশঙ্কা একদমই কমে যাবে। ২০২৪ সালের বিপ্লবের এটাই তো মূল লক্ষ্য, দেশে এমন একটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট তৈরি হতে না পারে।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের কয়েকটা বড় সুবিধার কথা বলি। যেহেতু একক কোনো ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না, তাই কারও কোনো নির্বাচনী এলাকা থাকছে না। ফলে নির্বাচনী এলাকায় টাকার ছড়াছড়ি বা পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ হয়ে যাবে।

ছোট রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশ থেকে যদি ১ শতাংশ ভোটও পায়, মানে প্রায় ১০ লাখ ভোট, তাহলে তারা সংসদে ৩টি আসন পেয়ে যাবে।

এতে করে সংসদে বহু দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ বা বলা যায় সর্বদলীয় সংসদ হবে। এমনও হতে পারে তখন সব দল মিলে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি কোনো দল গঠন করতে চায়, তারাও সংসদে আসন পেয়ে যাবে। দুই প্রতিনিধির মধ্যে এলাকাভিত্তিক মারামারি বন্ধ হওয়া, শত শত কোটি কালোটাকার ছড়াছড়ি বন্ধ হওয়া, এগুলো কি খুব বড় গুণগত পরিবর্তন নয়?

সংসদ সদস্যরা আইনপ্রণেতা, তাঁদের এলাকাভিত্তিক আসন না থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই, স্থানীয় উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আছে, এ ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা যেতে পারে।

এগুলোই হবে প্রকৃত সংস্কার। উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে, স্থানীয় রাজনীতিতে মাস্তানি করার সংস্কৃতি থেকে, সংসদ সদস্যদের বের করে আনা খুবই দরকার।

আনুপাতিক পদ্ধতির একটি বড় অসুবিধা হলো কেউ এককভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে না, তাকে অবশ্যই কোনো না কোনো নিবন্ধিত দলে যোগ দিতে হবে এবং সেই দলের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

আসন বণ্টন নিয়ে যে সমস্যাটা হতে পারে, তা হলো ফ্র্যাকশনের হিসাবটা কীভাবে হবে। যদি এ ব্যবস্থায় আমরা যাই তাহলে এই সমস্যা সমাধান করা কোনো কঠিন কাজ নয়।

এমন হতে পারে, একটি দলকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে, এর নিচে পেলে সেই ভোটগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং এই সুবিধাটা সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দল পাবে। হিসাবটা এমন হতে পারে, ধরুন এ, বি, সি, ডি, ই পাঁচটি দল নির্বাচনে অংশ নিল। তারা যথাক্রমে ৪৫.০২, ৪০.৫৮, ৮.৪০, ৫.১০ এবং ০.৯০ শতাংশ ভোট পেল। এবার আসন বণ্টন হবে ছোট সংখ্যা থেকে।

ই দল যেহেতু ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে, তাই কোনো আসন পাবে না। ডি দল পাবে [৩০০ X ৫.১০%] ১৫টি আসন, সি দল পাবে [৩০০X৮.৪০%] ২৫টি আসন, বি দল পাবে [৩০০X৪০.৫৮%] ১২১টি আসন এবং বাকি ১৩৯টি আসন পাবে এ দল। এই হলো ৩০০ আসনের হিসাব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই আসনগুলো দল কীভাবে বণ্টন করবে? আমার প্রস্তাব, প্রতিটি দল তাদের ৩০০ জন প্রার্থীর তালিকা নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেবে।

যে কয়টা আসন দল পাবে, সেই আসনগুলো তালিকা থেকে যাঁরা প্রথমে আছে তাঁদের মধ্যে বণ্টন করা হতে পারে। অথবা ৫০ শতাংশ তালিকার ক্রমানুসারে বাকি ৫০ শতাংশ দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বণ্টন করা যেতে পারে।

তবে অবশ্যই দলকে সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তালিকা থেকেই। নতুন করে কোনো নাম যুক্ত করতে পারবে না। অথবা পুরো সিদ্ধান্তটাই দল নিতে পারে, তবে অবশ্যই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অ্যান্ডোর্স করা তালিকার বাইরে যাওয়া যাবে না।

কারণ, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই জমা করা তালিকার প্রার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে অ্যান্ডোর্স করেছে। সংসদ সদস্য মনোনয়ন দাখিল করা তালিকা থেকে করার বিধান নির্বাচনের পরে টাকা দিয়ে আসন কেনার হিড়িক কমাবে। তা ছাড়া স্থানীয় উন্নয়নের বরাদ্দ যেহেতু সংসদ সদস্যরা পাচ্ছেন না, এমনিতেই টাকার ছড়াছড়ি কমে যাবে।

হোক না একটা নতুন কিছু। সম্ভবত দেশের জন্য এই নতুন ব্যবস্থা ভালোই হবে।

যেহেতু পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ এই আনুপাতিক ভোটের নির্বাচন বা প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি অনুসরণ করে সুফল পেয়েছে, পাচ্ছে এবং এটিকেই সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র বলা হচ্ছে, নিরীক্ষার খুব একটা ঝুঁকি আমাদের নিতে হচ্ছে না।

  • কাজী জহিরুল ইসলাম জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা