যেকোনো বিষয়ে পড়ে যেকোনো চাকরির সুযোগ যে ক্ষতি করছে

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি বক্তব্যের কিছু অংশ শুনলাম। দেশের বেকার সমস্যা নিয়ে। তাঁর বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। আরেকটা হচ্ছে, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং থাকাটা খুব দরকার।

মাননীয় উপদেষ্টা বলতে চেয়েছেন, আসলে মার্কেট-বেজড বা বাজারভিত্তিক বিষয়ে পড়াশোনা করা উচিত।

বাজারে যে বিষয়ের চাহিদা নেই, সে বিষয়ে না পড়ে এমন কোনো অলটারনেটিভ টেকনিক্যাল বা বিকল্প কারিগরি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত, যার বাজার-চাহিদা আছে।

মননে-প্রজ্ঞায় এলিট সৃষ্টি করা যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার মূল, শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বড় উপযোগিতা হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ জোগান দেওয়া।
সে কারণে দেখা যাচ্ছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘মার্কেট ওরিয়েন্টেড’ ডিগ্রি দেওয়ার দিকে ঝুঁকছে।

বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বাজারে যে ডিগ্রির চাহিদা নেই, সেটি বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও আউটকাম-বেজড এডুকেশন নামে নতুন সিলেবাস হচ্ছে (যদিও এর প্রণয়নপ্রক্রিয়া বা মেথডোলজি আমার কাছে মনে হয়েছে আরও বিশদ হওয়া উচিত)।

ডিগ্রিগুলোকে মার্কেট ওরিয়েন্টেড করার একটা বড় চেষ্টা হলো ইউনিভার্সিটি-ইন্ডাস্ট্রি অ্যালায়েন্স। বাংলাদেশে এটি একটি বাজওয়ার্ড বা কথ্যশব্দ।

তবে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে এটি দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির কার্যকরী পন্থা হতে পারে।

আমার জানামতে, শুধু বিজনেস স্কুলগুলোয় ইন্টার্নশিপ রিকোয়ারমেন্ট আছে, যেটি সাধারণত করপোরেট হাউসে সম্পন্ন করতে হয়। সাধারণভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এটির আধিক্য দেখা যায়।

কিন্তু ইদানীং যেহেতু সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস একটা ক্রেজ, তাই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও ইন্টার্নশিপের সুযোগ থাকা উচিত।

ইউনিভার্সিটি ইন্ডাস্ট্রি অ্যালায়েন্স হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানেও ইন্টার্নশিপ করতে পারেন। যেমন যাঁরা বিজনেস বা অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তাঁদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ থাকা উচিত অর্থ, বাণিজ্য বা শিল্প মন্ত্রণালয়ে।

যাঁরা অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াশোনা করছেন, তাঁরা ইন্টার্নশিপ করতে পারেন অডিট অ্যাকাউন্টস বা এনবিআরের বিভিন্ন বিভাগে।

এমন করে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর বিভাগগুলোয় কাজের সুযোগ থাকা উচিত।
কিন্তু বাংলাদেশে চাকরির কোনো স্পেশালাইজেশন বা বিশেষায়ণ নেই। বিশেষ করে সরকারি চাকরি বা বিসিএসের ক্ষেত্রে এ কথা খুবই সত্য।

২০১০-১১ সালের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পেশালাইজেশনের একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে সেটি কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়।

ফলে উর্দু কিংবা পালিতে পড়েও অনেকে হয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকার। আবার ব্যাংকিংয়ে পড়ে কেউ দেখা গেল চলে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ আনরিলেটেড ডিসিপ্লিনে।

মোটাদাগে এগুলোতে সমস্যা দেখা না গেলেও সূক্ষ্মভাবে দেখলে ব্যাপক সমস্যা ধরা পড়বে।

‘জ্যাক অব অল ট্রেডস মাস্টার অব নান’—এই প্রবাদের বাস্তবতা তখনই আমাদের সামনে ধরা পড়ে, যখন শুনি ১৮ কোটি মানুষের দেশে মিডলেভেল ম্যানেজমেন্টে যোগ্য লোক পাওয়া যায় না।

এ কারণে মালিকপক্ষ বিদেশ থেকে লোক নিয়োগ দেয়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে যত বিদেশি লোক কাজ করেন, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

অথচ বাংলাদেশে এমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে হিসাববিজ্ঞান পড়ানো হয় না।

এ সমস্যার সমাধান হিসেবে সরকারি চাকরিতে, বিশেষ করে বিসিএসের ফলে একটা ওজনদার মান রাখা উচিত। স্পেশালাইজড হলে তো অবশ্যই রাখা উচিত। অন্য চাকরির বেলায়ও তা প্রয়োগ করা উচিত।

যেহেতু যেকোনো বিষয়ে পড়ে যেকোনো চাকরিতে যাওয়ার সুযোগ আছে, সে কারণে ছাত্রছাত্রীরা আর কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গভীরভাবে পড়াশোনা করতে চাইছেন না। তাঁরা জানেন, চাকরির পরীক্ষার বিষয়বস্তু আলাদা এবং সবার জন্য একই।

এতে তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

এ সমস্যার সমাধান হিসেবে সরকারি চাকরিতে, বিশেষ করে বিসিএসের ফলে একটা ওজনদার মান রাখা উচিত। স্পেশালাইজড হলে তো অবশ্যই রাখা উচিত। অন্য চাকরির বেলায়ও তা প্রয়োগ করা উচিত।

  • আবদুল আলিম বাসের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, বর্তমানে ইউনিভার্সিটি মালায়ায় পিএইচডি গবেষণারত।