মতামত

গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর পথ কী

দেশের বর্তমান গ্যাস সরবরাহের সংকটকে অতীতের যেকোনো সংকটের চেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক বলে মনে করা হয়। গ্যাস সরবরাহের এ সংকটের কারণ দ্বিমুখী।

প্রথমত, দেশের অনেক গ্যাসকূপের উৎপাদন হার কমে গিয়ে মোট গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, গ্যাসঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানিও প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেছে।

ফলে আবাসিক এলাকায় নাগরিকেরা যেমন পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে রান্নার চুলা জ্বালাতে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন, তেমনি গ্যাসের অভাবে শিল্প উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি থেকে জনগণ এখন মুক্ত রয়েছেন বটে, কিন্তু আর তিন বা চার মাস পর গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে গ্যাসের সংকট লোডশেডিংকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে।

ব্যাপক নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে দেশে গ্যাসের চাহিদা অনেক বেড়েছে। দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ-ঘাটতি বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণ করার উদ্যোগ দুটি কারণে সফল হতে পারছে না।

প্রথমত, এলএনজি উচ্চ মূল্যের জ্বালানি। প্রয়োজনীয় এলএনজি আমদানি করার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন, সেখানে আমাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশে এলএনজি এনে তা গ্যাসে রূপান্তরিত করার পর্যাপ্ত টেকসই ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে।

গ্যাসের উৎপাদন ও মজুতের নিম্নমুখী ধারা

দেশে গ্যাস সরবরাহের চিত্রটি সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, দেশের গ্যাস উৎপাদন কেবল বর্তমান সময়ে কমেছে তা নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তা কমেছে।

২০১৬ সালে যেখানে গ্যাসের উৎপাদন ছিল ৯৭৩ বিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮৪০ বিলিয়ন ঘনফুট।

২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন হার ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (ইউনিট), যা ক্রমাগতভাবে কমে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে ২ হাজার ১৫০ ইউনিট এবং বর্তমানে তা ২ হাজার ৫০ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে।

ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শেল অয়েল কোম্পানি বাংলাদেশে পাঁচটি বৃহৎ বিশ্বমানের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করলে দেশটি বিশ্ব গ্যাস মানচিত্রে স্থান পায়। সেই পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র হলো তিতাস, হবিগঞ্জ, কৈলাসটিলা, বাখরাবাদ ও রশিদপুর।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরও নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু সেগুলোর প্রায় সব কটিই অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হওয়ায় দেশের মোট গ্যাস মজুত খুব বড় বাড়েনি। ১৯৯৭ সালে সিলেটে বিবিয়ানার মতো বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার আবার প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে বৃহৎ গ্যাস মজুতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি।

বাংলাদেশ সংগত কারণেই তার প্রধান প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে দেশের বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুত কমে যেতে থাকে। ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র তিতাসে প্রাথমিক মজুত ছিল ৬.৩৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ব্যাপকভাবে ব্যবহার করায় তিতাসের মজুত ২০২৩ সালের প্রথম নাগাদ কমে গিয়ে ১ দশমিক ১৪ টিসিএফ ঘনফুটে দাঁড়ায়।

একইভাবে হবিগঞ্জে মজুত ২ দশমিক ৬৩ টিসিএফ থেকে কমে ২০২৩ সালে শূন্য দশমিক শূন্য ৯৭ টিসিএফ হয়। বাখরাবাদে মজুত ১ দশমিক ২৩ টিসিএফ থেকে কমে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৩৫ টিসিএফ। দেশের সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রও তার প্রাথমিক মজুত ৫ দশমিক ৭৫ টিসিএফ থেকে কমে গিয়ে বর্তমানে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ টিসিএফ এ এসে ঠেকেছে। সাগরবুকে একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু ইতিমধ্যেই নিঃশেষিত ও পরিত্যক্ত।

এই তথ্য থেকে এটি প্রতীয়মান যে দেশের বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলো তাদের আদি মজুত ও সামর্থ্য হারিয়েছে এবং ভবিষ্যতে টেকসই গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে এগুলোর ওপর নির্ভর করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে নতুন গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলন করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে।

বর্তমানে দেশে দৈনিক চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ কমবেশি ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৮ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে এবং বাকি ২২ শতাংশ গ্যাস আমদানি করা এলএনজির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। একদিকে যেমন দেশীয় উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমে আসছে, অপর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল এলএনজি মূল্য ও দেশীয় এলএনজি সরবরাহের অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে তা আমদানিতে অনিশ্চয়তা রয়েই যায়।

বাংলাদেশের গ্যাসকূপ বিদেশি কোম্পানির কূপের তুলনায় কম হারে উৎপাদন করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশীয় কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।

গ্যাসকূপগুলোতে উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করার উপায় কী

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে গ্যাসের সংকটটি দেশে গ্যাসের অভাবের কারণে নয়, বরং দেশে মজুত থাকা গ্যাস সম্পদকে পর্যাপ্তভাবে উত্তোলন ও ব্যবহার করার ব্যর্থতাই দায়ী। দেশের গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির মূলত দুটি উপায় রয়েছে। কোনো গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন কূপের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে সে গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।

সিলেট অঞ্চলে ছাতক একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র। সেখানে অতীতে কেবল একটি কূপ থেকে উৎপাদন করা হতো। পরবর্তীকালে এ ক্ষেত্রে একটি ব্লোআউট দুর্ঘটনা ঘটে এবং এর উৎপাদন স্থগিত করা হয়। ১৮ বছর ধরে সেখানে উৎপাদন স্থগিত হয়ে আছে। গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে এখনো বড় আকারে উৎপাদন করা সম্ভব।

জাতীয় কোম্পানি পরিচালিত কৈলাসটিলা ও রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র দেশে প্রথম পাঁচটি সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে দুটি। কৈলাসটিলায় মাত্র চারটি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। রশিদপুরে মাত্র পাঁচটি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। তুলনায় বিদেশি কোম্পানি পরিচালিত পার্শ্ববর্তী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে ২৬টি কূপ খননের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়।

গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির অপর বিবেচ্য বিষয়টি হলো কূপপ্রতি গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। তিতাস বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র। জাতীয় কোম্পানির অধীন তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি ২৬টি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ৩৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করে। অর্থাৎ তিতাসে প্রতি কূপে উৎপাদিত হয় গড়ে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তুলনায় শেভরন পরিচালিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় ২৬টি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়, অর্থাৎ এটিতে প্রতি কূপে উৎপাদিত হয় গড়ে ৪২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ তিতাস বিবিয়ানার চেয়ে বড় মজুতের গ্যাসক্ষেত্র হলেও এটিতে গ্যাসের উৎপাদন হয় বিরিয়ানার এক-তৃতীয়াংশ। এর কারণ বিবিয়ানায় প্রতি কূপে উৎপাদন তিতাসের কূপপ্রতি উৎপাদনের চেয়ে বেশি।

২০১১ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তেল-গ্যাস কোম্পানি স্লামবার্জার লিমিটেডকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যেন তারা জাতীয় গ্যাসকূপগুলো পরীক্ষা করে উৎপাদনের হার কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তা শনাক্ত করে পরামর্শ দেয়। বছরব্যাপী এ পরীক্ষা চালানোর পর স্লামবার্জার কোম্পানি দেশে ৪৯টি উৎপাদনরত গ্যাসকূপ শনাক্ত করে, যেগুলোতে কারিগরি দুর্বলতার কারণে গ্যাসের উৎপাদন কম হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটি ওই কূপগুলোতে সহজ কারিগরি ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেয়, যা মূলত কিছু মেরামত, কিছু সমন্বয় ও কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজন (যেমন বড় ব্যাসের টিউবিং লাগানো) ইত্যাদি।

এসব কাজ কূপমুখে মাটির ওপর থেকে সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু পরামর্শ অনুযায়ী পেট্রোবাংলা কর্তৃক কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।

ওপরের আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয়, জাতীয় কোম্পানির গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রমে উন্নততর কারিগরি ব্যবস্থাপনা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আছে। জাতীয় কোম্পানি পরিচালিত গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদনের মাত্রার সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির কূপগুলোর উৎপাদনকে তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়।

গ্যাসবিজ্ঞান কোনো রকেট বিজ্ঞান নয় এবং তা যথার্থভাবে কাজে লাগানো আমাদের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশকে গ্যাসকূপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হলে উন্নততর কারিগরি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে।

● ড. বদরূল ইমাম অনারারি অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়