আনিসুল হকের লেখা

মায়েদের আঁচলের গন্ধটার নাম কী?

আমাদের মায়েরা ঘুমাতেন কখন? রাত তিনটার সময় বাড়ি ফিরলেও দরজা খুলতেন মা। শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে দরজা খুলে দিয়ে বলতেন, হাতমুখ ধো। টেবিলে খাবার দিচ্ছি।কোনো দিন তো বলেন নাই, টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা আছে, খেয়ে নে।

আমাদের ছোটবেলায় তো রেফ্রিজারেটর ছিল না, মাইক্রোওয়েভ ওভেনের তো প্রশ্নই ছিল না। কাজে মায়েরাই রাত দুইটা-তিনটায় ফেরা ছেলেকে নিজ হাত খাবার গরম করে দিতেন চুলা ধরিয়ে।

জ্বর হলে সন্তানের কপালে জলপট্টি দিতেন, কখনোবা কলাপাতা বা পলিথিন পেপার মাথার নিচে রেখে মাথায় পানি ঢালতেন আমাদের মায়েরা।

সবাইকে খাওয়াতেন, নিজে কী খেতেন, কেউ জানে না; হাতে গোনা মাসের টাকায় ১৪ জনের সংসার চালাতেন। সে সংসারে ফেলনা বলে কিছুই থাকত না; লাউয়ের খোসা ভাজি হতো; বিচি ভাজা ছিল রসনাবিলাস; মুরগির চামড়া বেগুন দিয়ে রাঁধলে হতো অমৃত ব্যঞ্জন।

শাড়ি পুরোনো হলে কাঁথা হতো; পাজামা পুরোনো হলে হতো কোলবালিশের খোল। মায়েদের হাতের তালু ছিল থার্মোমিটার; আঁচল ছিল সর্বরোগহরা। তা দিয়ে হাত মুছতেন মায়েরা, কপালের ঘাম মুছতেন, আর মুছে দিতেন সংসারের সব মালিন্য, দারিদ্র্য, জ্বরব্যাধি, মন-খারাপের ব্যামো।

এরই মধ্যে বছর যেতে না যেতেই তাঁদের হতে হতো পোয়াতি। সন্তান উৎপাদন থেকে শুরু করে সংসারের প্রধানমন্ত্রিত্ব, অর্থমন্ত্রিত্ব, খাদ্যমন্ত্রিত্ব, স্বাস্থ্যমন্ত্রিত্ব, শিক্ষামন্ত্রিত্ব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়—সবকিছুর ভার তো ছিল আমাদের মায়েদেরই। হাতপাখার ডাঁটাটা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজটা দিব্যি চালিয়ে নিতে পারতেন।

 সেই মায়েদের কথা কি আমরা মনে রেখেছি!

 স্নেহ নিম্নগামী। আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের জন্য জীবনবাজি রেখে কত-কী করেছেন! আর আমরা তার বিনিময়টুকু দিই আমাদের সন্তানদের! গর্ভবতী মা কত সাবধানে থাকেন, এটা কোরো না, পেটের বাচ্চা কষ্ট পাবে, ওটা খেয়ো না; ওর ক্ষতি হতে পারে। রিকশায় উঠো না, রিকশায় বড় ঝাঁকুনি। আর সংসারে একটা নবজাতক এল, তো সব মনোযোগ, সব আনন্দ, সব হাসিকান্না, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কেন্দ্রভূমি ওই ছোট্ট সত্তাটি।

কাজী নজরুল ইসলাম ঠিকই লিখেছেন:

 পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর

 এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!

 কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,

 রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।

ওই একটা ছোট্ট সত্তাকে একটু একটু করে বড় করে তুলতে মা কী না করেন! সে যে তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন। দশটা মাস নিজের পেটে নিজের পুষ্টি-রক্ত দিয়ে বড় করেছেন। জন্মের পর থেকে বুকের স্তন্য থেকে শুরু করে নিজের সবটুকু ভালোবাসা-মায়া-যত্ন উজাড় করে দিতে থাকেন মা।

নিজে না ঘুমিয়ে জেগে থাকেন, যেন শিশুসন্তানের ঘুমে একটু ব্যাঘাত না ঘটে। বাচ্চা একটুখানি অ্যাঁ করে উঠতেই ছুটে আসে সবাই। মা-বাবা আর পরিবারের অন্য সকলে। এমন যে আদরের শিশুসন্তান, সে যখন বড় হয়, তখন সে উড়তে শেখা পাখিসন্তানের মতোই উড়াল দিয়ে মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। মা-বাবার কথা তার মনে পড়ে কি পড়ে না! তবে তার সমস্ত স্নেহ-মায়া আবার তার সন্তানের জন্য সিঞ্চিত হতে থাকে! এই তো চক্র!

আব্বাকে নিয়ে আমি একটা রচনা লিখেছিলাম। আব্বার ছিল ডায়াবেটিস। মিষ্টি খাওয়া ছিল বারণ। আব্বা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। ডায়াবেটিসের কারণে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ হলে এই সমস্যার তিনি অপূর্ব সমাধান বের করেন।

তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে যেতেন। বলতেন, এই, এদের সবচেয়ে বড় রসগোল্লা দাও। সেটা খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই বলতেন, এবার রসমঞ্জরি দাও। আমরা খেতাম। আব্বা চেয়ে চেয়ে দেখতেন। তাঁর মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেত।

আমার একটা কবিতায় আমি লিখেছিলাম, রংপুর গেলে আম্মা ভাত বেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে খাওয়া দেখতেন। আমি খেলে সেই ভাত তাঁর পেটে গিয়ে পড়ত। তাঁর পেট ভরে যেত। কাঁসার গেলাসে পানি নিয়ে আম্মা দাঁড়িয়ে থাকতেন, যদি আমি পানি চেয়ে বসি। সেই পানি না খেয়ে ফের যদি ঢাকা চলে আসি আমি, আম্মা গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকবেন, দাঁড়িয়েই থাকবেন, তিনি যেন বায়েজিদ বোস্তামী।

এই ছবির গল্পে আছে, নতুন মা-বাবা তাঁদের গর্ভস্থ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য কত কীই না করেন! আর আছে সেই প্রশ্ন: ‘আমরা যে আমাদের বাচ্চার জন্য এত কিছু করছি, বড় হয়ে সে কি সেসব মনে রাখবে?’ উত্তরও আছে: ‘না। রাখবে না। আমরা কি আমাদের মা-বাবার স্যাক্রিফাইস মনে রেখেছি?’

আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি লেখক কর্মশালায় গিয়েছিলাম, ওখানকার একজন শিক্ষার্থী কবি আমার কিছু কবিতা অনুবাদ করে আসরে পড়ে শোনান। শিক্ষার্থী–শ্রোতাদের সবাই বলেছিল, তোমার এই কবিতাটা সবচেয়ে ভালো—যেখানে তুমি লিখেছ, ভাত গিয়ে মায়ের স্টমাকে ল্যান্ড করে। আমাদের মায়েরাও একই রকম। আমরা বাড়ি গেলে ‘এটা খাও, ওটা খাও’ বলেন আর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

 আপনাদের একটা তথ্য জানাই। আমার এই কবিতাটা ‘তোমাকে ভাবনা করি’ নামের একটা বইয়ে প্রকাশিত হয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কবিতাটা পড়ে এমন আবেগাপ্লুত হন যে তিনি তাঁর ভাইবেরাদারদের নির্দেশ দেন, যাও, বইমেলায় গিয়ে আনিস ভাইয়ের কবিতার বইটা কিনে এই কবিতাটা পড়ো।

২.

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার লেখা উপন্যাস ‘আয়েশামঙ্গল’ থেকে প্রথম ছবি বানান ২০০১ সালে। আমার মেয়ের বয়স তখন ৬। আমার মেয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ায়। ফারুকীর অনেকগুলো ছবির গল্প বাংলা থেকে ইংরেজি করে দেওয়ার কাজটা সে করে দিয়েছে। সরয়ার ফারুকী একদিন আমাকে বলেছিলেন, ভাই, আগে আপনি আমার স্ক্রিপ্ট লিখতেন, আজকে আপনার মেয়ে আমার স্ক্রিপ্টের টিমে কাজ করে।

সরয়ার ফারুকী ওর মা-বাবাকে কী চোখে দেখেন, কিছুটা আমরা জানি। তিশার সঙ্গে ওর বিয়ে, ওদের মেয়ে ইলহামের জন্ম, তিশা ফারুকীর ছবিতে অভিনয় করবে কি করবে না, নানা বিষয়ের সঙ্গে দূরবর্তীভাবে হলেও আমি আর মেরিনা যুক্ত।

এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ দেখে আমি ও মেরিনা আবেগতাড়িত বোধ করব!

এই ছবির গল্পে আছে, নতুন মা-বাবা তাঁদের গর্ভস্থ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য কত কীই না করেন! আর আছে সেই প্রশ্ন: ‘আমরা যে আমাদের বাচ্চার জন্য এত কিছু করছি, বড় হয়ে সে কি সেসব মনে রাখবে?’ উত্তরও আছে: ‘না। রাখবে না। আমরা কি আমাদের মা-বাবার স্যাক্রিফাইস মনে রেখেছি?’

কিন্তু যখন দেখি, আমার মতো অন্য অনেকেই, আফজাল হোসেন, তারিক আনাম, অমিতাভ রেজা, অনম বিশ্বাস, দেশ-বিদেশের অনেক রিভিউয়ার, ফেসবুকের নাম না-জানা বন্ধু এই ছবিটার প্রশংসা করছেন, তখন বুঝি, কিছু কিছু অনুভূতি আছে, যা দেশ-কাল-ব্যক্তির গণ্ডির ঊর্ধ্বে, যা সব মানুষের মনে একই রকমভাবে ক্রিয়া করে থাকে।

’চরকি’র ছবি সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফিতে আমাদের মায়েদের আটপৌরে শাড়ির আঁচল থেকে আসা গন্ধ আছে। তার নাম কী, আমার জানা নেই।

  •  আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক