২৪ নভেম্বর পিটিআইয়ের প্রধান ইমরান খান ‘ফাইনাল কল’ দিয়েছেন। ইসলামাবাদে তাঁর কর্মী–সমর্থকেরা ‘ছিনিয়ে নেওয়া ম্যান্ডেট’, অন্যায় গ্রেপ্তার ও ২৬তম সাংবিধানিক সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামবেন রাজধানী ইসলামাবাদে।
তেহরিক-ই-ইনসাফের জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি সরকারের ব্যর্থতা এবং দুর্বল কর্মক্ষমতা। এ সমস্যাটি ইমরান খানের নিজেরও ছিল। তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন তাঁর সাড়ে তিন বছরের সরকারের সময়, বিশেষ করে পাঞ্জাবে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা’ প্রস্তাব আনা হয়েছিল। অল্পের জন্য নতুন জীবন পেয়েছিল তাঁর সরকার।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বরের মধ্যে রাজনীতির অক্ষ আর বদলায়নি। মিডিয়ার ৮০ শতাংশ খবর ও মন্তব্য শুধু খান সাহেবকে নিয়েই হতো। গত ৮ ফেব্রুয়ারির ফলাফল বাদ দিয়ে, দলভিত্তিক নির্বাচনে ‘স্বাধীন’ যত প্রার্থী জিতেছেন, তাঁর ৯০ শতাংশের সম্পর্ক ছিল পিটিআইয়ের সঙ্গে। আমি আমার গণতান্ত্রিক বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করি, যদি পিটিআই তাদের নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ পেত, তাহলে ফলাফল কী হতো?
যাহোক, ইমরানের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কী কারণে পিটিআই এখনো একটি সফল প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন খান সাহেবকে ‘ফাইনাল কল’ দিতে হয়েছে, তা ভেবে দেখার মতো একটি ব্যাপার। আর তা তাঁর নিজের দলেরও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এই কল তো তাঁর দলের জন্য চ্যালেঞ্জ; আর ইমরান খানের নিজের জন্যও বড় ঝুঁকি।
পিটিআইকে এই আন্দোলনে ‘একা’ মনে হচ্ছে কেন? ইমরান খান নিজেও ‘বিচ্ছিন্নতার শিকার’। আর তা তাঁর কৌশলের কারণে। একদিকে তিনি নিজেই একটি ছয়-দলীয় জোট গঠন করেছেন। কিন্তু ‘ফাইনাল কল’ দেওয়ার আগে কোনো দলকে বিশ্বাস করেননি, আলাপ করেননি। তাঁর সেসব জোটের নেতারা কোথায়? এসব নিয়ে পিটিআই নীরব কেন? খানের বিচ্ছিন্নতার আরেকটি কারণ আছে।
এই কঠিন সময়ে তাঁর অনেক বিশ্বস্ত সহকর্মী তাঁকে ছেড়ে গেছেন। সম্ভবত এ কারণে যে তিনি নিজে যাঁদের মনোনীত করে উঁচু পদে বসিয়েছেন, তাঁদেরও তিনি আর বিশ্বাস করেন না। আজ তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি এবং বোন কার্যত রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। বোন আলেমা খান দলের কোনো পদে না থাকা সত্ত্বেও ‘ফাইনাল কল’ ঘোষণা করেছেন।
অন্যদিকে সরকারের সবচেয়ে বড় ঝামেলা হচ্ছে তার ‘সুনাম’ নিয়ে সমস্যা। যাহোক, এটা তো আর ২০১৪ নয়, যদিও তখনো মুসলিম লীগ (এন) সরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরিফ।
ইমরান খান ১২৬ দিন ডি চকে অবস্থান ধর্মঘটে বসেছিলেন। শেষে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশনের মাধ্যমে ঝামেলা শেষ হয়েছিল। সর্বোপরি ওই সময় যে অবস্থান ধর্মঘটে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি, তার কারণ কী? এর কারণ কি এই যে সে সময় আসল ক্ষমতাধরদের সমর্থন ইমরান খানের সঙ্গে ছিল? নাকি ৯ মের ঘটনা?
১৭ মাস হয়ে গেল। মামলাগুলো এগোনোর নামই নিচ্ছে না। মামলাগুলো নিয়ে আজও রাজনীতি করা হচ্ছে। তবে খোদ সেনাবাহিনীর মধ্যেই অনেক অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হচ্ছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আসন্ন।
এমন অবস্থায় ইমরান ও পিটিআইয়ের প্রতিবাদ বর্তমান সরকারের চেয়ে বেশি আসল ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষমতাধরেরা কোনো ধরনের আলোচনা করতে প্রস্তুত নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা বা চুপ করিয়ে দেওয়ার ইতিহাস আছে। এসব কারণেই দলের চেয়ে পরিবারের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেশি। এমন এক সময়ে, যখন পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের চারপাশে বৃত্ত সংকুচিত করা হচ্ছে, তখন ‘ফাইনাল কল’ দিয়ে ইমরান খান তাঁর সমর্থকদের কাছ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারির মতো প্রতিক্রিয়া আশা করছেন। তা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে স্ত্রী-বোনের ভূমিকা বাড়তে পারে। দলের লোকেরা যখন বিক্রি হয়ে যান, তখন পরিবারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া ইমরান খানের উপায় কী?
যেকোনো প্রতিবাদ আন্দোলনে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠন, ঐক্য, আদর্শ, আবেগ, কৌশল, নিজের প্রতিপক্ষের শক্তি মূল্যায়ন, সমর্থক ও কর্মীদের বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নামানো, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপে দলের আইনি অংশের ভূমিকা, আলোচনার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো এবং আলোচনার সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে মূল্যায়ন।
এই মুহূর্তে এমন এক সময়ে প্রতিবাদের ডাক দেওয়া হয়েছে, যখন রাষ্ট্র ও সরকারের সুস্পষ্ট নীতি হলো গ্রেপ্তার এবং সব উপায়ে ‘বিক্ষোভ’ দমন ও ইসলামাবাদকে কোনো রকম আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা।
এখন যদি সড়ক-মহাসড়কে ধরনা দেওয়া হয়, তাহলে এই ঠান্ডা ও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় তা সহজ হবে না। ২০১৪ সালের অবস্থান ধর্মঘটের মতো এখন পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ বিষয়টিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। তেহরিক-ই-ইনসাফ যদি অস্বাভাবিক রকম শক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়, তবে আগামী সময়ে তার জন্য আরও কঠিন হয়ে যাবে।
এমন এক পরিস্থিতিতে ইমরানের ‘রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা’ তাঁর ক্ষতি করতে পারে। জোটের পক্ষ থেকে এই ‘কল’ ঘোষণা করা হলে ভালো হতো। এ লক্ষ্যেই তো জোট গঠন করা হয়েছিল। এই প্রতিবাদে যদি জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম আর আর জামায়াতে ইসলামী জড়িত থাকত, তাহলে এই প্রতিবাদকে ‘একক চেষ্টা’ বলা যেত না।
ইমরান হয়তো তাঁর ভোটার ও সমর্থকদের কাছ থেকে আশা করছেন যে তাঁরা ৮ ফেব্রুয়ারির মতো পথে বের হয়ে আসবেন। ইমরান খান আসল ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ‘আলোচনার’ দরজা বন্ধ করেননি। কিন্তু সমস্যা হলো ওপাশ থেকে কেউ দরজা খুলতে আসছে না।
তবে পিটিআইয়ের অনেক নেতা মনে করেন, পূর্ণ প্রস্তুতির পর ঘোষণা দিলে ভালো হতো। তবে যাঁরা ‘মারো নয়তো মরো’ স্লোগানের পক্ষপাতী তাঁরা আবার চিন্তিত যে দলের মধ্যে যেসব গুপ্তচর আছেন, তাঁরা কখন পরিকল্পনা ফাঁস করে দেন, তার কোনো ঠিক নেই। গুরুত্বপূর্ণ নেতা অনেকে এই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত বলে মনে হয়। এসব কারণেই ইমরান খান এখন তাঁর স্ত্রী বুশরা ও বোন আলেমার ওপর রাজনৈতিকভাবে বেশি নির্ভর করতে শুরু করেছেন বলে মনে হয়।
অনেকে ইমরানের এই রাজনৈতিক কৌশলের সমালোচনা করেছেন। সব সময় রাজনীতিতে পরিবারপ্রথার সমালোচনা করে এখন নিজেই সেদিকে এগোচ্ছেন ইমরান। ২৪ নভেম্বরে ফাইনাল কলের ফলাফল দেখে জানা যাবে ইমরান খানের সমালোচকেরা কতটা সঠিক। ইমরান খানের দীর্ঘ সাজা হলে বিবি বুশরা বা বোন আলিমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। যেমন হয়েছিল ১৯৭৮ সালে বেগম নুসরাত ভুট্টো বা জেনারেল মোশাররফের আমলে বেগম কুলসুম নওয়াজের। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, পিটিআইয়ে পরিবারপ্রথা আছে বলেই মনে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা বা চুপ করিয়ে দেওয়ার ইতিহাস আছে। এসব কারণেই দলের চেয়ে পরিবারের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেশি। এমন এক সময়ে, যখন পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের চারপাশে বৃত্ত সংকুচিত করা হচ্ছে, তখন ‘ফাইনাল কল’ দিয়ে ইমরান খান তাঁর সমর্থকদের কাছ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারির মতো প্রতিক্রিয়া আশা করছেন। তা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে স্ত্রী-বোনের ভূমিকা বাড়তে পারে। দলের লোকেরা যখন বিক্রি হয়ে যান, তখন পরিবারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া ইমরান খানের উপায় কী?
মাজহার আব্বাস সাংবাদিক, জিওটিভির বিশ্লেষক
জংগ থেকে নেওয়া, উর্দু থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন