কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে জার্মানির ফুটবল লিগ বা বুন্দেসলিগা খেলার শেষ দিনটিতে জার্মানির বিভিন্ন শহরের স্টেডিয়ামগুলো ফুঁসে উঠেছিল। স্টেডিয়ামগুলোর হাজারো দর্শক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অভিবাসীশ্রমিক শোষণের দেশ কাতারের বিশ্বকাপ বর্জনের ডাক দেয়।
দর্শকেরা মানবাধিকার লঙ্ঘন, জলবায়ুদূষণ ও বিশ্বকাপের জন্য স্টেডিয়াম ও অন্যান্য স্থাপনার জন্য ১৫ হাজার শ্রমিকের মৃত্যুবিষয়ক স্লোগান দিয়ে বিশাল ব্যানার টাঙিয়ে দেয়। বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ৫ নভেম্বর বুন্দেসলিগা খেলার সময়, এমন একটি ব্যানারে লেখা ছিল: ‘৫৭৬০ মিনিটের ফুটবলে ১৫ হাজার মৃত্যু! আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’ এবারের বিশ্বকাপে ৬৪ খেলার ৯০ মিনিট সময় হিসাব করে ৫ হাজার ৭৬০ মিনিটের কথা বিক্ষোভকারীরা বলতে চেয়েছেন।
৩২ দেশের প্রতিনিধিত্বে ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফিফা বিশ্বকাপের আসর বসবে কাতারে। ১২ বছর আগে ২০১০ সালে তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্লাটার কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই একটির পর একটি ঘুষ কেলেঙ্কারির পর্দা উন্মোচিত হতে থাকে। অর্থকড়ি নানা রকম ব্যবসা জুটিয়ে দেওয়া, সমালোচনকারীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া এ রকম অজস্র অসাধুতা অবলম্বন করে কাতার তার বিশ্বকাপ ভেন্যু ধরে রাখতে সক্ষম হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ঘুষ কেলেঙ্কারি, যা গত বছরগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে, তা কাতারের বিশ্বকাপ ফুটবল উৎসবে নান্দনিকতার চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়েছে।
গত ৩০ বছরে ছোট উপসাগরীয় দেশ কাতার খেলাধুলায় বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ বিশ্বশক্তির হওয়ার পেছনে রয়েছে অনৈতিকতা এবং অর্থকড়ির লেনদেন। বিশ্বদরবারে নিজেদের পরিচিতির জন্য কাতারের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হলো ‘কাতার ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০।’ আর এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে গ্যাস এবং তেল রপ্তানির অঢেল পয়সা।
সামিরা এল ওয়াসিল তাঁর প্রতিবেদনের শেষে লিখেছেন, যাঁরা ফুটবল ভালোবাসেন, তাঁরা কাতারে মৃত অভিবাসীশ্রমিকদের নিয়ে চুপ থাকতে পারেন না। সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ প্রতীকীভাবে তাদের সমাধির ওপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের যে উৎসব উচ্ছ্বাস ও নান্দকিতার ঐতিহ্য, তা ১৫ হাজার শ্রমিকের মানবেতর মৃত্যুর কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হবে।
১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা বা ফিফা নাইজেরিয়াতে জুনিয়র বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সময় নাইজেরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন অত্যন্ত লোভী এবং নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক সানি আবাচা। তা অবশ্য ফিফার জন্য কোনো সমস্যা ছিল না। তবে জুনিয়র বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে নাইজেরিয়াজুড়ে কলেরা ও মেনিনজাইটিস রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ফিফার তৎকালীন সভাপতি জোসেফ ব্লাটার খুব দ্রুত জুরিখে তাঁর অফিসে বসে জুনিয়র বিশ্বকাপ ফুটবলের নতুন ভেন্যু কাতারের নাম ঘোষণা করে। ১৯৯৮ সালে ফিফা প্রধান হিসেবে জোসেফ ব্লাটার বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আবার সভাপতি নির্বাচিত হন। ফিফার এই নির্বাচনের ভোটারদের ক্রয় করার পেছনে ছিল কাতারের অসাধু অর্থবল। এর পরপরই জোসেফ ব্লাটার কাতারের অন্যতম মিত্র হয়ে দাঁড়ান। সভাপতির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কাতার ফিফাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
যুব বিশ্বকাপ ফুটবল ছাড়াও কাতারের বর্তমান শাসক যুবরাজ তামিম বিন হামাদ আল থানি ২০১৩ সালে দেশটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি হন। তিনি কাতারে অনেকগুলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনে সমর্থ হন। টেবিল টেনিস, ভারোত্তলন, সাইক্লিং, শৈল্পিক জিমন্যাস্টিকস বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মতো অনুষ্ঠানগুলো কাতারে হয়েছিল। অবশ্য কাতারের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক।
এবারের বিশ্বকাপ কাতারে অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকাটি লিখেছে, গোপন ক্যামেরা এবং টেপসহ ছদ্মবেশী সাংবাদিকেদের তথ্য থেকে ফিফার ২৪ জন নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাতারকে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসেবে ভোট দেওয়ার দুর্নীতির বিষয়টি জানা যায়। তদন্তে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত হলে ২৪ জন নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্য দুজন আজীবন এবং কুড়ি জনকে নির্দিষ্ট সময়ের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পত্রিকাটি আরও লিখছে, কাতার এমন একটি দেশ, যারা অর্থ প্রতিপত্তি দিয়ে সবকিছু ক্রয় করতে চায়। যদিও বিশ্বকাপের আয়োজনের সিদ্ধান্তে ফিফার লোভী দুর্নীতিবাজ নির্বাহী কমিটির সদস্যরাই দায়ী। তবে কাতার নানা এজেন্সির মাধ্যমে ভোট ক্রয়ের জন্য অর্থ ও অনৈতিক প্রলোভন দেখিয়েছিল।
বাংলাদেশের ৩২ বছর বয়স্ক সুজন মিয়া একজন পাইপ ফিটার হিসেবে কাজ করতে কাতারে যান। তিনি মরুভূমিতে বিশ্বকাপের একটি অবকাঠামোতে কাজ করছিলেন। তাঁর মৃত্যুর চার দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি। হঠাৎ তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। অথচ সুজন মিয়ার কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না।
বিশ্বকাপ ফুটবলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরপরই কাতার সাতটি স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর, আবাসন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহনসহ নানা উচ্চাভিলাষী নির্মাণকাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কাতারে প্রায় ২০ লাখ অতিথি শ্রমিক বসবাস করলেও বিশ্বকাপের আয়োজনকে সামনে রেখে দেশটিতে আরও বাড়তি ৪ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এই বাড়তি শ্রমিকদের বেশির ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশ থেকে আনা হয়েছিল।
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে অবকাঠামো নির্মাণের শীর্ষ সময়ে ৪ লাখ শ্রমিকদের মধ্য শুধু স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণ করতেই ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে মানবেতর পরিবেশে কত শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন, তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ৫ হাজার ৯২৭ জন। এই হিসাবের মধ্য ফিলিপাইন ও আফ্রিকার দেশগুলোর শ্রমিকদের বাইরে রাখা হয়েছে।
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ‘ইন দ্য প্রাইম অব দিয়ার লাইভস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত এক দশকে, হাজার হাজার তরুণ অভিবাসীশ্রমিক কাতারে হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে মারা গেছেন। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাতারে ১৫ হাজার ৭৯৯ শ্রমিক মারা গেছেন। তাঁরা কাতার সরকারের অভিবাসী মৃত্যুর রেকর্ড থেকে এই সংখ্যার কথা জানিয়েছে। এসব শ্রমিক কাতারে কাজে যাওয়ার আগে বাধ্যতামূলক ফিটনেস মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এত শ্রমিকের প্রাণহানির পরও কাতার কর্তৃপক্ষ আজ অবধি তাদের মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে।
কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রাক্কালে অতিথি শ্রমিকদের মৃত্যু বা জলবায়ু সুরক্ষার পরিবর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম এসব বিষয় এখন সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকায় সামিরা এল ওয়াসিল, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের ছয় মৃত অভিবাসীশ্রমিকের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৩২ বছর বয়স্ক সুজন মিয়া একজন পাইপ ফিটার হিসেবে কাজ করতে কাতারে যান। তিনি মরুভূমিতে বিশ্বকাপের একটি অবকাঠামোতে কাজ করছিলেন। তাঁর মৃত্যুর চার দিন আগে সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি। হঠাৎ তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। অথচ সুজন মিয়ার কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল না। সামিরা এল ওয়াসিল তাঁর প্রতিবেদনের শেষে লিখেছেন, যাঁরা ফুটবল ভালোবাসেন, তাঁরা কাতারে মৃত অভিবাসীশ্রমিকদের নিয়ে চুপ থাকতে পারেন না। সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ প্রতীকীভাবে তাদের সমাধির ওপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের যে উৎসব উচ্ছ্বাস ও নান্দকিতার ঐতিহ্য, তা ১৫ হাজার শ্রমিকের মানবেতর মৃত্যুর কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হবে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি