বারগুতিকে প্রায়ই ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’ বলে ডাকা হয়। দখল করা পশ্চিম তীর ও গাজায় জনমত জরিপে বারগুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা।
বারগুতিকে প্রায়ই ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’ বলে ডাকা হয়। দখল করা পশ্চিম তীর ও গাজায় জনমত জরিপে বারগুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা।

মারওয়ান বারগুতিই কি তাহলে ফিলিস্তিনিদের শেষ ভরসা

ফিলিস্তিন একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে কিংবা সেটা অমীমাংসিত হয়ে রয়েছে।

দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের বৈধতাকে অস্বীকার করা যাবে না। রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (যে পার্টিটা তুরস্কের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল) একজন সদস্য হিসেবে আমি ফিলিস্তিনিদের সংকটের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্ততা অনুভব করি।

কিন্তু যেকোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এই বিবেচনায় ২০০৬ সাল থেকে ফিলিস্তিনে নির্বাচন না হওয়ার বিষয়টাকে উল্লেখ করার মতো প্রতিনিধিত্বহীনতা বলা যায়।

২০২১ সালে ফিলিস্তিনিরা যে নির্বাচনটা করার কথা ভেবেছিল, সেটা বাতিলের প্রধান একটা কারণ হলো দখল করা পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েল কোনো ভোট করতে দেবে না। এভাবে তারা অসলো চুক্তির লঙ্ঘন করেছিল।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) বোধগম্যভাবেই এটিকে ফিলিস্তিনের অবিচ্ছেদ্য অংশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখেছে। ইসরায়েলি দখলদারি ও দমনপীড়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিষয়টাকে বিশ্বের চোখে খাটো করা।

নির্বাচন না হওয়ার কারণে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের নেতৃত্ব বাছাইয়ের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গণতন্ত্র জবাবদিহি ও স্বচ্ছতায় পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রের ঘাটতি এত শক্তভাবে গেড়ে বসেছে যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে অদক্ষতা ও দুর্নীতি পাকাপোক্ত গেড়ে বসেছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র একটা পথ খোলা আছে। আমি বিশ্বাস করি, মারওয়ান বারগুতিই একমাত্র মূল ব্যক্তি, যিনি কিনা ফিলিস্তিনের এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভেঙে ফেলতে পারেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় সামনের সারির নেতা বারগুতি ২২ বছর ধরে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তাঁর মামলা এখন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় আমাদের মনোযোগ দাবি করে।

বারগুতিকে প্রায়ই ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’ বলে ডাকা হয়। দখল করা পশ্চিম তীর ও গাজায় জনমত জরিপে বারগুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা।

অসলো শান্তি আলোচনায় বারগুতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি দুই পক্ষেরই নিরাপদে বসবাসের পক্ষে তিনি। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি—দুই জনগণের জন্য দুটি রাষ্ট্র; যারা পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে বাস করবে—এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন।

বারগুতির কাছে ফিলিস্তিনি জনগণের মঙ্গল সবার আগে। বারগুতির বয়স এখন ৬৫। ২০ বছর ধরে তিনি যে কারাগারে রয়েছেন, সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত নির্দয়। সেই পরিবেশের মধ্যেই তিনি ফিলিস্তিনিদের চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়া রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দুর্বলতর অবস্থান এবং ইসরায়েলি ঔপনিবেশিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিরোধ না থাকায় সমালোচনা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের জন্য তিনি একটা জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।

সাংবাদিক গিডিয়ন লেভি সম্প্রতি বারগুতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘মৃতপ্রায় ফিলিস্তিনি ইস্যুটাকে বাঁচিয়ে তোলার তিনিই একমাত্র সুযোগ।’ ৭ অক্টোবরের পর লেভির এই মন্তব্য অন্ধকারময় একটা বাস্তবতার প্রতিফলন করে। লেভি বলেন, ‘আমি তাঁর প্রতি মহান বিশ্বাসী একজন এবং যেহেতু আমি তাঁকে বিশ্বাস করি এবং অনেক মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল তাঁকে কখনোই মুক্তি দেবে না এবং এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

বারগুতি প্রকৃত পক্ষে ইসরায়েলি নীতি সম্পর্কে খুবই সচেতন। এই নীতিই তাঁকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। ৭ অক্টোবরের কয়েক মাস আগে তিনি জায়নবাদের সংকট নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, সেখানকার আদি বাসিন্দাদের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে ইসরায়েল তার গণতন্ত্রের চাকচিক্য ধরে রাখতে সংগ্রাম করছে।

বারগুতি তাঁর লেখায় আরও উল্লেখ করেন, ইসরায়েলে সামরিক–বেসামরিক, ধর্মবাদী–সেক্যুলার, আশকেনাজি–সেপার্ডিক ইহুদিদের মধ্যে যে ভারসাম্য, সেটা আরও বেশি সামরিক, ধর্মবাদী ও আশকেনাজি উপদল তৈরি করছে।

ইসরায়েলি সমাজের এই পরিবর্তন উগ্র ডানপন্থী শক্তির উত্থান ঘটাচ্ছে, ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক নৈতিকতাকে মুছে ফেলছে। শুধু ফিলিস্তিনিরা নন, ভিন্নমতাবলম্বী যাঁরা উগ্র-ডানপন্থী শাসক শ্রেণির বিরোধিতা করছেন, তাঁদেরকে ইসরায়েল রাষ্ট্র কোণঠাসা করছে, তাঁদের অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করছে।

বারগুতির কাছে ফিলিস্তিনি জনগণের মঙ্গল সবার আগে। বারগুতির বয়স এখন ৬৫। ২২ বছর ধরে তিনি যে কারাগারে রয়েছেন, সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত নির্দয়। সেই পরিবেশের মধ্যেই তিনি ফিলিস্তিনিদের চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়া রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দুর্বলতর অবস্থান এবং ইসরায়েলি ঔপনিবেশিক তৎপরতার বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিরোধ না থাকায় সমালোচনা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের জন্য তিনি একটা জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।

বারগুতির এই কথাগুলো প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে ঐক্য ও শান্তির একটা দৃষ্টিকে সামনে এনেছে। এই শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে যে বারগুতিকে কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাঁকে নির্জন কক্ষে রাখা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ।

বারগুতি একজন সেক্যুলার রাজনীতিবিদ। জনগণ তাঁকে শান্তির প্রতীক বলে মনে করেন এবং তাঁর জনগণ সেই শান্তির আকাঙ্ক্ষাকেই লালন করেন। এ রকম একজন রাজনীতিবিদকে ক্রমাগত জেলে বন্দী করে রাখার মানে হচ্ছে আমাদের বর্তমান সভ্যতা যে যৌথ মানবাধিকার লালন করে, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ।

ফিলিস্তিনি জনগণ অত্যন্ত সহনশীল এবং তারা তাদের বৈধ অধিকারের জন্য সম্মানের যোগ্য। বসতি স্থাপনকারীরা জলপাইগাছগুলো ধ্বংস করে ফেললেও জলপাইগাছের শাখা বিস্তারের সামর্থ্য ফিলিস্তিনিদের আছে।

মাহমুদ দারবিশের কবিতার ভাষায়, ‘আমাদের ক্ষতবিক্ষত হাতগুলো এখনো গণহত্যার উদ্যানের ধ্বংসস্তূপ থেকে নেতিয়ে পড়া জলপাই শাখা বের করে আনার সক্ষমতা রাখে।’

  • ওগুজ কান সালেসি ইস্তাম্বুলের বোগাজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপক
    মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত