ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সম্পদের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া ও পশ্চিম (যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো) উভয় শিবির থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ ও মানবসম্পদ মোতায়েন করা হচ্ছে। প্রত্যেকেই প্রতিপক্ষকে পিছু হটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। উভয় শিবিরেই অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ইউরোপকে বিধ্বস্ত করে ফেলতে পারে, এমন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি একটি শিবির থেকেই আসছে, সেটি হলো রাশিয়া।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কঠোর নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে রাশিয়া। সোভিয়েত জমানায় তৎকালীন সরকার তাদের সম্পদের বড় অংশ সমরাস্ত্রে রূপান্তর করে যে বিশাল মজুত গড়েছিল, সেই মজুত ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং দ্রুততার সঙ্গে তা শেষ হয়ে আসছে। এর পাশাপাশি কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্রও রাশিয়া প্রয়োগ করছে। তবে এসব অস্ত্রের মধ্যে এমন কিছু অস্ত্র আছে, যা রাশিয়ার লক্ষ্যপূরণের মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা রাখে না।
ইউক্রেন একটি পারমাণবিক যুদ্ধের মূল্য হতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যা করতে পারে কিংবা ইউক্রেন যা সত্যিই করছে, তাতে ভয় পেয়ে যদি মস্কোর ঘুঁটি চালানোর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা ইউরোপের জন্য অনেক বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে
এ কারণে রাশিয়া তার ঘুঁটির চাল পাল্টে ফেলেছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি বেলারুশে পারমাণবিক ওয়ারহেডযুক্ত ইসকান্দের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন, যা চূড়ান্ত সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ইসকান্দের একটি স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ওয়ারশ, কিয়েভসহ পোল্যান্ড, ইউক্রেনের প্রধান প্রধান অংশে আঘাত হানতে সক্ষম। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তির শর্তকে লঙ্ঘন করে না, যদিও ২০১৯ সালেই রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার উইপনস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার পরপর যুক্তরাষ্ট্রও একই কাজ করেছিল।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের মূল রণক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য ইউরেনিয়াম বিস্ফোরকে সজ্জিত চ্যালেঞ্জার-২ নামের ট্যাংক পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বেলারুশে তারা এই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কোনো যৌক্তিক সাদৃশ্যপূর্ণ পন্থা নয় এবং কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্রেনে মার্কিন অ্যাব্রাম ট্যাংকও (অবশ্য সেই ট্যাংকে ইউরেনিয়াম বিস্ফোরক নেই) দেখা যাবে।
রাশিয়ার অস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে আসা তার অস্ত্র ব্যবহারের ধরন বদলের একটি কারণ হলেও আসল কারণ হলো, ইউক্রেনে ন্যাটোর সেনা পাঠানোর সম্ভাব্যতা। পোল্যান্ড ইতিমধ্যে তার সেনাবাহিনীর আকার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা তৈরি করছে। ফ্রান্সে নিযুক্ত পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি বলেছেন, মিত্রদেশ ইউক্রেনের সেনাবাহিনী নড়বড়ে হয়ে পড়লে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে ‘বাধ্য হবে’।
পুতিনের কাছে পোল্যান্ডের স্থলসেনা সজ্জিত করার অর্থ হলো, ন্যাটো বাহিনী এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তার মানে হলো, ন্যাটো তার সমরাস্ত্র, বিশেষ করে বিমানশক্তি ও কৌশলগত বোমারু বিমান ব্যবহার করবে। অনুমানের ভিত্তিতেই হোক আর বাস্তবতার নিরিখে, ন্যাটোর সম্ভাব্য সচল হওয়ার বিষয়টিই রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের আসল কারণ।
রাশিয়া অনেক দিন থেকে বলে আসছে, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করেছে, তা শুধুই আকাশসীমা পাহারা দেওয়ার জন্য নয়। পুতিন ও তাঁর জেনারেলরা বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাতানো এজিস অ্যাশোর ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেমে এম-৪১ নামের যে লঞ্চার আছে, তা দিয়ে শুধু অনুপ্রবেশকারী রকেট ধ্বংস করা যায় তা নয়, বরং এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে বিজিএম-১০৯জি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া সম্ভব।
আমেরিকান টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড এখন প্রচলিত ওয়ারহেডের মতো হলেও মূলত এগুলো পারমাণবিক ওয়ারহেডযুক্ত করে বসানো এবং সোভিয়েত বিমানব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে পারার সক্ষমতাবিশিষ্ট করে ডিজাইন করা হয়েছিল।
টমাহকের পারমাণবিক ওয়ারহেড ডব্লিউ-৮০ যে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, তার মাত্রা পাঁচ থেকে দেড় শ কেটি (কিলো টন) যেখানে হিরোশিমায় ব্যবহৃত অ্যাটম বোমার মাত্রা ছিল ১৩ থেকে ১৮ কেটি। যুক্তরাষ্ট্রের এই ওয়ারহেডগুলোকে ২০১০ ও ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অবসরে পাঠানো হলেও সেগুলো সক্রিয় মজুতখানায় গুদামজাত করা আছে।
অন্যদিকে রাশিয়ার গুদামে মজুত থাকা বিপুল পরিমাণের তথাকথিত ‘কৌশলগত’ পারমাণবিক অস্ত্র ভূমি, আকাশ ও সাগর থেকে নিক্ষেপণযোগ্য। রাশিয়া তার পারমাণবিক ওয়ারহেড হালনাগাদ করছে বলে কোনো আভাস এখন পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও বেলারুশে ইসকান্দের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবে সেই জনধারণাকে বদলে দিয়েছে।
রাশিয়ার নেতারা ও বিশ্লেষকেরা বারবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলছেন। হয়তো জনগণকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে মানসিকভাবে তৈরি করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা এটি করছেন। এ ছাড়া মস্কোর চারপাশের আকাশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও জোরদার করতে পুতিন নির্দেশ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সরবরাহ করা সব ট্যাংক ও এয়ারক্র্যাফট হাতে এসে পৌঁছানোর পর ইউক্রেন বসন্তের শেষে কিংবা গ্রীষ্মের শুরুতে বড় ধরনের আক্রমণে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এ আক্রমণ অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হবে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। এ বিশদ পরিসরের সামরিক আক্রমণে ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর কিছু দেশও যুক্ত হতে পারে। এ অবস্থায় ক্রিমিয়াকে হাতছাড়া হওয়া ঠেকাতে রাশিয়াকে মরিয়া হয়ে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে হতে পারে।
ইউক্রেন একটি পারমাণবিক যুদ্ধের মূল্য হতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যা করতে পারে কিংবা ইউক্রেন যা সত্যিই করছে, তাতে ভয় পেয়ে যদি মস্কোর ঘুঁটি চালানোর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে তা ইউরোপের জন্য অনেক বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে। সেই ধরনের অবস্থায় যাওয়ার আগে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে একটি পরমাণু অস্ত্র চুক্তিতে আসতে হবে এবং সেই চুক্তিতে অবশ্যই চীনকেও যুক্ত রাখতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির একজন সিনিয়র ফেলো এবং
সোশানা ব্রায়েন দ্য জুইশ পলিসি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পরিচালক