মতামত

শিক্ষার্থীদের হাতে আমরা কী তুলে দিচ্ছি 

নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে
নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে

এ বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রায় সাড়ে চার শ সংশোধনী দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ সংবাদে শিক্ষক-অভিভাবকদের একটি বড় অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলছেন, পাঠ্যপুস্তকের নামে আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে আসলে কী তুলে দিচ্ছি? বইয়ে এত ভুল থাকার পরও কীভাবে তা ছাপাখানায় পাঠানোর অনুমোদন পায়? আর যে বই পুরো শিক্ষাবছরের জন্য তৈরি করা হয়, সেটি প্রণয়নে এই ছেলেখেলার মানে কী? এবারের ভুলের পরিমাণ দেখে শিক্ষকেরাও স্তম্ভিত। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রধান শিক্ষক এসব সংশোধনী শ্রেণিশিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জানাবেন এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তকে তা সংযোজনের ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু ভুল ধরে ধরে এত সংশোধনী কীভাবে প্রতিটি বইয়ে সংযোজন করা সম্ভব, তা শিক্ষকেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না।

পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে প্রতিবছরই সংবাদ হয়। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়। তারা সেই বই পড়া শুরু করতে না করতেই বইয়ের ভুল নিয়ে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক সাধারণ তথ্যেও ভুল থাকে। এসব ভুল নিয়ে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা এর আগে আদালতে রিট পর্যন্ত করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপনার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট সদস্যদের তলবও করেছেন হাইকোর্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোর্ড কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে এবং সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু পরের বছর আবার নতুন নতুন ভুল নিয়ে সংবাদ হয়েছে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। 

পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে এনসিটিবির আদৌ কোনো উৎকণ্ঠা আছে বলে মনে হয় না। থাকলে ভুলের প্রবণতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারত। অবশ্য একে ‘প্রবণতা’ না বলে ‘অপরাধ’ বলা ভালো। কারণ, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া বইয়ে ভুল থাকা মানে দায়িত্বে অবহেলা। এ অবহেলা রীতিমতো অপরাধ। যেসব ভুল সাধারণ মানুষ ও প্রুফরিডারের চোখেও ধরা পড়ে, সে ধরনের ভুল স্কুলপাঠ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে থাকে কীভাবে? একেকটি বইয়ে লেখক-সম্পাদক হিসেবে ১০ থেকে ১৫ জনের নাম থাকে। বইটি চূড়ান্ত হিসেবে ছাড়ার আগে তাঁরা কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন? দৈনিক পত্রিকায় প্রতিদিন শত শত সংবাদ, প্রতিবেদন, লেখা ছাপা হয়। সেখানেও তো এত ভুল দেখা যায় না। এমনকি বাংলাদেশের অনেক প্রকাশনা সংস্থার নাম উল্লেখ করা যায়, যারা প্রায় নির্ভুল বই বের করে। 

ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ বাদ দিলে এনসিটিবি একটি পূর্ণ প্রকাশনা সংস্থা। জাতীয় শিক্ষাবিস্তারের প্রধান প্রকাশনা হয়েও প্রতিষ্ঠানটি যথেষ্ট উৎকর্ষের পরিচয় রাখতে পারছে না। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এখানে ছবি আঁকার জন্য নেই নিজস্ব ইলাস্ট্রেটর, পৃষ্ঠাসজ্জার জন্য নেই গ্রাফিক ডিজাইনার, বানান ও ভাষারীতি দেখার জন্য নেই প্রুফরিডার। বিভিন্ন কাজে লোক নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও ত্রুটি রয়ে গেছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে অদক্ষ লোকে ভরে গেছে এনসিটিবি। তা ছাড়া বইয়ের লেখক হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদেরও দলীয় পরিচয় ছাড়া আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না। আর অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকেরা শুধু নামেই সম্পাদক থাকেন—প্রকাশের আগে অনেকে বইয়ের কপিও দেখেন না। 

এত কিছুর পরও আমরা বলি, ভগ্নপ্রায় শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কিন্তু সব কাজে কেন যেন তাড়াহুড়া করা হচ্ছে। গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই একসঙ্গে করা হলো। এ বছর অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই একসঙ্গে করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ কারণে এবার আরও বেশি ভুল ও অসংগতি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া নতুন শিক্ষাবছরের চার মাসে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা শিক্ষাবিদদেরও ভাবিয়ে তুলেছে।

মজার ব্যাপার হলো, যাঁরা এবার নতুন শিক্ষাক্রমের বইগুলো লিখেছেন, তাঁরাই আবার এসব বইয়ের ভুল বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন। বিষয় ও ভাষাদক্ষ অন্য এক দল শিক্ষকের হাতে বইগুলো সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হলে হয়তো আরও অনেক ভুল খুঁজে পাওয়া যেত বা যাবে। বইয়ের শুরুতে ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’ লিখে দেওয়ার মানে এই নয়, শত শত বানান ও তথ্যগত ভুল রয়ে যাবে। ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’-এর অর্থ বইয়ের কোনো আলোচনায় পরিবর্তন আনার কিংবা কোনো অধ্যায় বা অনুশীলনী যোগ-বিয়োগ করার দরকার আছে কি না, তা দেখা। একই সঙ্গে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে বা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো সংকট তৈরি হচ্ছে কি না, তা যাচাই করা। অথচ ‘পরীক্ষামূলক সংস্করণ’-এর দোহাই দিয়ে আমরা সাধারণ ভুলের তালিকা করে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি। 

মনে রাখা দরকার, পাঠ্যবইকে শিক্ষার্থীরা প্রামাণ্য মনে করে। বইয়ে ভুল থাকলে পাঠ্য বিষয়ের ওপর তাদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তাই বইয়ের কাজে জড়িত সবাইকে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। ইদানীং বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও দায়িত্বশীল লেখক-সম্পাদকের অভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও অনিয়মের কারণে এ রকম হচ্ছে। তা ছাড়া এনসিটিবি যে সম্মানী দিয়ে থাকে, তা দিয়ে সম্পাদক-লেখকদের ‘ব্যস্ত সময়’ কেনা সম্ভব হয় না। এনসিটিবির সম্মানীতে চিত্রশিল্পীরাও কাজ করতে চান না। এর ওপর আছে সম্মানী পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতা! 

এত কিছুর পরও আমরা বলি, ভগ্নপ্রায় শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কিন্তু সব কাজে কেন যেন তাড়াহুড়া করা হচ্ছে। গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই একসঙ্গে করা হলো। এ বছর অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই একসঙ্গে করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ কারণে এবার আরও বেশি ভুল ও অসংগতি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া নতুন শিক্ষাবছরের চার মাসে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যা শিক্ষাবিদদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। এবার পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে দুই মাস অতিরিক্ত সময় লেগেছে। এসব পাঠ্যবইয়ে ত্রুটি নেই—এ দাবি করেও পরে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে। 

শেষে আরেকটি কথা। আগে বিভিন্ন বিষয়ের একাধিক বই ছিল। এ বছর পাঠ্যবইয়ের চাপ কমিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ে একটি করে বই তৈরি করা হলো। যেমন এক বাংলা বিষয়ের জন্য আগে ছিল তিনটি বই—গদ্য-কবিতা, আনন্দপাঠ ও ব্যাকরণ।

এখন সেখানে বই একটি। এ রকম সব বিষয়ে একটি করে বই করার মৌখিক পরিকল্পনা থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানে ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ ও ‘অনুশীলনী পাঠ’ নামে দুটি বই করা হয়েছে। এ বিভাজন যদি কার্যকরই হবে, তবে তো অন্য বিষয়েও দুটি করে বই দিতে হয়! 

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক