বিদেশি মেহমানদের কী দেখাতে চান নেতারা

ঢাকামুখী যানবাহন থামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন পুলিশের সদস্যরা। আমিনবাজার, ঢাকা, ১২ জুলাই
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

সড়ক বন্ধ করে জনগণের সমস্যা বাড়িয়ে সমাবেশ করা যাবে না—এ যুক্তিতে গত বছর ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও সরকার সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। সমাবেশটি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে গোলাপবাগ মাঠে। গোলাপবাগে গণতন্ত্রের গোলাপ না ফুটলেও সরকারের একগুঁয়েমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এবার সরকার বিএনপিকে সেই পল্টনেই জনসভা করতে দিয়েছে। একই দিন বিএনপি ও সমমনা ৩৬টি রাজনৈতিক দলও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করবে। কেবল তা–ই নয়, একই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট বরাবর যে সড়ক আছে, সেখানে বিশাল শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে।

গত ডিসেম্বরে বিএনপির সমাবেশের দিনটি ছিল শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মানুষের বিড়ম্বনা কম হয়েছে। আর এবার সরকারি ও বিরোধী দল মিলে সড়ক-মহাসড়কে যে সমাবেশ করতে যাচ্ছে, সেটি সরকারি অফিস চলাকালেই।

কয়েক দিন ধরেই ঢাকার ও ঢাকার বাইরের মানুষের মধ্যে উদ্বেগাকুল প্রশ্ন ছিল, ১২ তারিখে কী হবে? ১২ তারিখ সব দল সড়ক দখল করে সমাবেশ করলে নিত্যযানজটের শহর তো অচল হয়ে যাবে। আমাদের রাজনীতি তো জনগণের সব সড়ক অচল করার জন্য, সচল করার জন্য নয়। তারা একে অন্যের চোখে ধুলো দিয়ে আনন্দ পায়।

বিরোধী দলের দাবি এক দফা। ভোটের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারি দলের দাবি, তারা ক্ষমতায় থেকেই ভোট করবে। যদি বিরোধী দল বাধা দেয়, দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। বিরোধী দলকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে গিয়ে গণতন্ত্রের দাঁতই যে সব কটি ভেঙে গেছে, সেটা তারা খেয়াল করছে না।

এই যে জনজীবন অচল করে সরকারি ও বিরোধী দল মহাসমাবেশ থেকে মহাকর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে, তার একটিই উদ্দেশ্য—নির্বাচন। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করা। দুই পক্ষই দেখাতে চায় যে তাদের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন আছে। এ জন্য তারা কী করছে? ঢাকার জনজীবন অচল করে সমাবেশের ডাক দিয়েছে। এ রকম সমাবেশ আমরা এরশাদের আমলেও দেখেছি। তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে বলেছে, আমরা ভোটের অধিকার চাই। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও বলেছে, আমরা ভোটের অধিকার চাই। এখন আওয়ামী লীগ আমলেও বিএনপি ও তার সহযোগীরা একই কথা বলছে।

তাহলে বাংলাদেশ কত এগোল? এত মানুষ যে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিল—সবই নিষ্ফল হলো? কেন তারা ভোটের বিষয়টি আলোচনা করে সমাধান করতে পারে না? কেন পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করতে হয়? কার কতটা জনসমর্থন আছে, সেটি প্রমাণ করার স্থান রাজপথ নয়, ভোটের বাক্স।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের প্রতি আস্থাশীল হতো, তাহলে তারা সবাই মিলে একটি সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করত। আসলে তারা জনগণের ভোটাধিকারের চেয়ে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়।

বিরোধী দলের দাবি এক দফা। ভোটের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সরকারি দলের দাবি, তারা ক্ষমতায় থেকেই ভোট করবে। যদি বিরোধী দল বাধা দেয়, দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। বিরোধী দলকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে গিয়ে গণতন্ত্রের দাঁতই যে সব কটি ভেঙে গেছে, সেটা তারা খেয়াল করছে না। বিরোধী দল বলছে, তারা নিরুপায় হয়ে এই সমাবেশ করছে। একই দিন, একই সময়ে সরকারি দলের সমাবেশ করার কী যুক্তি ছিল? সরকারি দল অন্য দিন সমাবেশ করতে পারত। তাদের একটাই যুক্তি, বিদেশি মেহমানদের ‘শক্তি দেখানো’।

মার্কিন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু (ডানে) এখন বাংলাদেশ সফর করছেন।

বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আছে। তারা এসেছে নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ স্বচক্ষে দেখতে। সরকারি ও বিরোধী দলের কোনো পক্ষ এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। তারা বিদেশি মেহমানদের সঙ্গে বিগলিত চিত্তে আলোচনা করবে, কিন্তু নিজেরা কথা বলতে রাজি নয়।

সমাবেশ শুরু হবে বিকেলে। কিন্তু দুপুরের আগে থেকে যেসব খবর আসছে, তা গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। শহরের প্রবেশপথগুলোয় পুলিশ টেকপোস্ট বসিয়ে বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর তল্লাশি চালাচ্ছে। মুঠোফোনেও বিএনপি খুঁজছে। অনেক স্থানে যানবাহন আটকে দেওয়ায় হেঁটে দলের নেতা–কর্মীরা ঢাকায় ঢুকছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ১০ জন আটকের খবর পাওয়া গেছে। অথচ সরকারি সরকারি দলের নেতা–কর্মীদের আসার পথে পুলিশ বাধা দিচ্ছে না। তাঁদের ওপর তল্লাশিও চালানো হচ্ছে না। এর মাধ্যমে বিদেশি মেহমানদের কী দেখাতে চাইছেন ক্ষমতাসীনেরা?

সরকারি ও বিরোধী দল যত পারুক শক্তি দেখাক। কিন্তু শহরের বাসিন্দাদের জিম্মি করে সেটা হতে পারে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেটা হয় না। নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা থাকলে সেটি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হওয়া উচিত। বিদেশি বন্ধুরাও সেই বার্তা অনেক দিন থেকে দিয়ে আসছে। এমনকি অনেক বিদেশি সংস্থা আলোচনায় সহায়তার জন্য দূতও পাঠিয়েছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কেউ কাউকে তিল পরিমাণ ছাড় দিতে চায়নি। অতীতে আওয়ামী লীগ ছাড় দেয়নি, এখন বিএনপিও সেই অবস্থান নিয়েছে।

তাহলে সমাধান কী? সমস্যা তো কেবল নির্বাচন নিয়ে নয়; সমস্যাটা হলো গণতন্ত্রের। সমস্যা হলো একগুঁয়েমির। সমস্যা হলো অন্য পক্ষের মত শোনার মানসিকতা না থাকা। গণতন্ত্রের জন্য এত আন্দোলন, এত হরতাল-অবরোধ হলো, এত মানুষ আত্মাহুতি দিল, তারপরও কেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো না? কেন নির্বাচন এলেই সংকট ঘনীভূত হয়? মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আছে, আবার ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার করা হবে কি না।

সমাবেশ ঘিরে দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা আছে। আছে কে কত বেশি লোক হাজির করতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতা। গত কয়েক দিন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা কোনো দলেরই সমর্থক নন, তাঁরা দুই দলের সমাবেশ নিয়ে খুব চিন্তিত নন। তাঁরা চিন্তিত মরিচের দাম নিয়ে। তাঁরা চিন্তিত সমাবেশের দিন সন্তানকে নিয়ে স্কুল থেকে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন কি না? কোনো সংঘাত হবে কি না।

আমরাও আশা করি, কোনো সংঘাত হবে না। অন্তত বিদেশি মেহমানদের কাছে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রমাণ করতেও তারা সংঘাতে যাবে না। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হোক, সেটাই আমজনতার চাওয়া। তার চেয়ে বেশি চাওয়া একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি। ই-মেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com