ক্ষমতার ক্ষুধা: চলমান রাজনীতির ক্ষয় ও ক্ষরণ

আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে স্বাগত জানাতে আসা গাড়িবহর। ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরে আচরণবিধি ভেঙে ‘শোডাউন’ করেছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী
ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের প্রবণতা দেখে সমাজে ক্ষমতার ক্ষুধা বোঝা যাচ্ছে। ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য বা ক্ষমতা পাওয়ার জন্য রীতিমতো এক ইঁদুরদৌড় দেখা গেল। এ দৌড়ে বাদ ছিল না শিক্ষক, খেলোয়াড়, আইনজীবী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, নেতা ও খুদে নেতা।

নির্বাচনী মনোনয়ন-দৌড় লিটমাস কাগজ হয়ে উঠছে। এ কাগজে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে সমাজের গভীর ক্ষত। ক্ষমতার সঙ্গে নৈকট্যবোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

ক্ষমতাবান হওয়া বা ক্ষমতার সঙ্গে নৈকট্য তৈরি ছাড়া হালে এ সমাজের আর কোনো সংগতি নেই। সমাজ শাসক ও নেতা তৈরির কারখানা হয়ে উঠেছে। দরকার প্রচুর শাসক, শোষক আর ছড়ি ঘোরানো অনুগত বাহিনী। দলে দলে অনুগত মানুষের ঝাঁক।

মানুষের ঝাঁক ধরা পড়ছে মিছিলে-মিটিংয়ে। আগে পায়ে-পায়ে জনতা মিছিলে অংশ নিত। সেখানে যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল বা গাড়িবহর। রাজনৈতিক তৎপরতায় মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের মিলন ঘটেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। মিছিলে কণ্ঠের পরিবর্তে শোনা যাচ্ছে হর্নের যন্ত্রণা। এখন মিছিল থেকে স্লোগান আসে না, আসে না মুক্তির বারতা, আসে কেবল নিরর্থক মেকানিক্যাল সাউন্ড। এটাও একধরনের পতন।

ক্ষমতাবানেরা নিয়ত সৃজনশীল নন। তাঁরা ভাষাবন্ধ্যা। নেই নতুন ভাষা। কেবল পুরোনো ভাষা কচকচানি। কেন্দ্রীয়ভাবে উৎপাদিত স্লোগানগুচ্ছের কোরাস ধ্বনিত হচ্ছে প্রান্ত অবধি। ক্ষমতা আজ প্রগতিশীলতার কারক নয়, বদ্ধতার মহাসূত্র। ক্ষমতাবানদের আরাধ্য ইট-পাথর-রড-সিমেন্ট। কারণ, এগুলো থেকে চুইয়ে পড়ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ক্ষমতা ও টাকা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতির মতো শুদ্ধাচার খুন হয়ে গেল।

ক্ষমতাবানদের কাছে জনগণ আজ এক থিকথিকে দলার নাম। মাঝেমধ্যে জনগণের নাম স্মরণ করতে বাধ্য হন তারা। তবে জনগণের সম্মতি তাদের কাছে জরুরি নয়। কারণ, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে একটি মেকানিক্যাল স্ট্রাকচার, যার পরতে পরতে ষড়যন্ত্রের শকট। এখানে নানা কৌশল প্রয়োগে উৎপাদন করা হচ্ছে জনসম্মতি।

সমস্যা হলো মানুষ একবার যা দেখে ফেলে, তাকে অদেখা বানানো যায় না। এসব অপতৎপরতা জনগণ দেখছে এবং তা যথাযথভাবে জাতীয় স্মৃতিভান্ডারে জমা হচ্ছে। একটি ভঙ্গুর জাতীয় স্মৃতিভান্ডার নিয়ে জনগণ সামনের দিকে এগোচ্ছে। এ দুঃসহ স্মৃতিভান্ডার সময়-সুযোগমতো বন্যতা উসকে দেয়।

সমাজে পরিশীলিত, রুচিশীল, গুণীজন বা আলোকবর্তিকার প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে। সমাজে গুণীর কদর কমছে, বাড়ছে নেতা ও প্রশাসকের কদর। ক্লেদাক্ত রাজনীতির ঘন অরণ্যে এ চাষ চলছে দুর্বার গতিতে।

মানুষ বুঝে গেছে, ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, বদলি-পদায়ন, মামলা-মোকদ্দমা সুরক্ষিত করতে হবে। যে সমাজে সুষ্ঠু পরিচালন কাঠামো গড়ে ওঠেনি, মানুষ সেখানে সুরক্ষা খোঁজে, সম্ভাবনা নয়। মানুষ ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায়, সংযুক্ত থাকতে চায়। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনীতির সঙ্গে মানুষের এ সংযুক্তিপনা বাড়ছে প্রবল দাপটে। মানুষ কেবল রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায় না, হতে চায় অগ্রনায়ক, নেতা। নেতার হয়ে ওঠার বাসনা মহামারি আকার ধারণ করেছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে উঠছে ক্ষমতার উৎসব। কেবল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগৃহীত হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। গড়ে প্রতিটি আসন থেকে ১১ জনের ওপরে ফরম সংগ্রহ করেছেন। সংবাদপত্রের তথ্যমতে, কোনো কোনো আসন থেকে ২০ থেকে ২২টি পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে।

ক্ষমতার এ ক্ষুধা এক দিনে তৈরি হয়নি। সামাজিক অসমতা এর পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মানুষ দেখেছে, যিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, পদপদবিতে আছেন, তিনি এগিয়ে গেছেন অদম্য গতিতে। মানুষ জেনে গেছে, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে অর্থবিত্তে দুর্ভাবনা নেই। পাঁচ বছর আগে ও পরে হলফনামার বিবরণীতে সেই নির্মম সত্য উঠে আসছে বারবার।

ক্ষমতাবানেরা হয়ে উঠছেন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে এক দুর্বিনীত দঙ্গল। তাঁরা আর দশজন মানুষের মতো একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাস করেন, কিন্তু তাঁদের ওপর কোনো বিধিবিধান, আইনকানুন কাজ করে না। ইচ্ছা আইন হয়ে যায়। অনেকে মজা করে বলেন, আইন সুবোধ বালকের মতো সব সময় আব্বুর (রাষ্ট্রের) হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করে।

সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা কঠিন হলো। অদূর ভবিষ্যতে তার সম্ভাবনা অনুজ্জ্বল। কারণ, গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হচ্ছে। যেনতেন উপায়ে এগিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। মানুষ নগদ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

মনে রাখতে হবে, কর্তৃত্ববাদী শাসন জারি থাকলে মানুষ ভয় পায়। তাদের কাণ্ডজ্ঞান সীমিত হয়ে আসে। কর্তৃত্ববাদী শাসন কর্তৃক উৎপাদিত রোটোরিক বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার শক্তি সীমিত হয়ে আসে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্বার্থে শাসক গোষ্ঠীর দরকার প্রচুর কাঁচা মানুষ ও বুদ্ধিহীন জনস্তূপ।

মানুষের অদম্যতা, চিন্তা ও মৌলিক চরিত্র ধ্বংস করতে না পারলে কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় সবাই একইভাবে চিন্তা করবে, চলাফেরা করবে, অনুগত থাকবে, সম্মতি দেবে। সমাজে কর্তৃত্ববাদী শাসন যে পাকাপোক্ত হচ্ছে, তার একটি বড় প্রবণতা হলো রাজনৈতিক একরৈখিকতা। বৈচিত্র্য হারিয়ে এক হয়ে যাওয়া। দেশের রাজনীতি ঠিক ওই গতিমুখে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ব্যক্তিকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য বিস্তর লড়াই করতে হয়। অথচ হাতে ক্ষমতা থাকলে অবলীলায় চলে আসে অর্থ, প্রভাব ও প্রতিপত্তি। উঠতি নগদজীবীরা বুঝে গেছে, রাজনীতিতে বিনিয়োগ উত্তম দাওয়া। একবার এ শিকে ছিঁড়লে তার গতি বিরামহীন।

এখন সমাজে রাজনীতি ও ক্ষমতা ছাড়া আর কোনো গল্প নেই। তৈরি রয়েছে বাধ্যতামূলক গল্প শোনার সংস্কৃতি। সামাজিক পরিসর, আড্ডা, সখা-স্বজন মিলন, চায়ের স্টল, সবুজ প্রান্তর—সবখানে পঙ্কিল রাজনীতির গল্প। নানা গল্পের বর্ণাঢ্য সম্ভার বাংলা সংস্কৃতি। জয়-পরাজয়, হাসি-কান্না, ঘর-গৃহস্থালি, চাষাবাদ, বন্যা-খরা, উৎসব-পার্বণ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মিলিয়ে গল্পের এ ঝাঁপি। কত কথক, কত গল্পকার আমাদের। রাজনীতির দোর্দণ্ডপ্রতাপে গ্রাম্য কথক বা গল্পকারেরা হারিয়ে যাচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন।

সে জায়গা দল করছে উঠতি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। তাঁরা বিশেষ বাহনে চেপে মোড়ে মোড়ে বাধ্যতামূলক গল্প শোনানোর পরিবেশ তৈরি করছেন। সামাজিক কথকদের গল্পে স্বস্তি ছিল, ছিল বিনোদন, যা ছিল মূলত সংযোগসূচক, রাজনৈতিক কথকতা হম্বিতম্বিসর্বস্ব, বিযুক্তির ব্যাকরণ।

অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতার গল্প শুনতে কানগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক সচেতনতা আর রাজনৈতিক বিকার এক বিষয় নয়। রাজনীতি হলো সবচেয়ে শুদ্ধতম সক্রিয়তা। এ শুদ্ধতম সক্রিয়তায় অংশগ্রহণ ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। অথচ সেই রাজনীতি গণমানুষের মুক্তির দিশারি না হয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কবজ হয়ে উঠছে।

সমাজে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভক্তি দৃশ্যমান হচ্ছে। শাসক বা প্রশাসকেরা কেবল ক্ষমতার আধার নন, ক্ষমতা প্রদর্শনে পারঙ্গমও বটে। ক্ষমতার যৌক্তিক ব্যবহারের চেয়ে নির্বিচার ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ।

ক্ষমতা থেকে উৎসারিত কর্তৃত্ব। কর্তৃত্ব, ন্যায়বোধ ও অভিলক্ষ্য সমান্তরাল বিষয়। অবৈধ কর্তৃত্ব, ন্যায়হীনতা ও অসৎ উদ্দেশ্যের মিশেলে রাষ্ট্রাচারে বিপর্যয় নেমে আসছে। প্রতিষ্ঠানগুলো উইপোকার ঢিবির মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। প্রতিষ্ঠান সক্রিয় না থাকলে মানুষের সুরক্ষা আসবে কোথা থেকে? সমাজে অচলায়তন তৈরি হচ্ছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা ছাড়া এ অচলায়তন কাটানো সম্ভব নয়।

দেশ চলছে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও সুবিধাগোষ্ঠীর নেক্সাসে। এ অবস্থায় বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়েছে উইন-উইন সিচুয়েশন। সবাই নিজের মতো করে জিতে যাচ্ছে। কেবল হারছে জনগণ। এখন ব্যক্তির জয় কঠিন নয়, কিন্তু সামষ্টিক বড় কঠিন।

রাজনীতির ঘেরাটোপের ভেতর সংস্কৃতিবোধ অপস্রিয়মাণ। রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। স্বার্থান্ধতা, স্থূলতা ও বন্ধ্যত্বের নিবিড় বসতি আজ রাজনীতি। আদর্শগতভাবে রাজনীতি এক অবারিত জানালা, যার চালক হলো সহাবস্থান, ভিন্নমত, বৈচিত্র্য ও পরার্থবোধ। সাংস্কৃতিক পরিশীলন চর্চিত হলে কারও পক্ষে অন্যায়-নিষ্ঠুরতাও দেখানো সহজে সম্ভব হয় না।

ক্ষমতার জ্বর কাটিয়ে গণমানুষকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয় বিকশিত হোক, সে আশা ধরে রাখাও জরুরি। কারণ, আশাবাদী মনোভাব হতাশার চেয়ে কল্যাণকর।

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগবিশেষজ্ঞ