মতামত

নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক, সিইসির উপলব্ধি এবং আওয়ামী লীগের নতুন দুশ্চিন্তা

লেখাটি শুরু করছি ডেইলি স্টার–এর খবরটি দিয়ে। শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় একিউআই স্কোর ৩১১ নিয়ে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় আবারও শীর্ষে উঠে এসেছে ঢাকা।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। এই মানের বাতাস বাসিন্দাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। বায়ুদূষণের কারণে নানা রোগে মৃত্যুহারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা প্রায়ই বায়ুদূষণে শীর্ষে থাকে, কিন্তু এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় আমাদের রাজনীতিবিদদের হয় না। তাঁরা দিনের পর দিন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত থাকেন। 

এই যে সারা দেশ তীব্র শীতে কাঁপছে, ঠান্ডাজনিত রোগে শিশু ও প্রবীণেরা আক্রান্ত হচ্ছেন, এসব নিয়ে নেতা-নেত্রীরা কথা বলেন না। দলের পক্ষ থেকে শীতার্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার খবরও প্রায় দুর্লভ। 

নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল, অদূর ভবিষ্যতে তা শেষ হবে বলে মনে হয় না। যেভাবেই হোক ৭ জানুয়ারি নির্বাচনটা হয়ে যাওয়ার পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।

৩০ জানুয়ারি সংসদ বসছে কিন্তু নির্বাচনী বিতর্ক থামেনি। আগে বিতর্কটা সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সীমিত ছিল। এখন সরকারি দল নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক জিইয়ে রেখেছে। নৌকা বনাম স্বতন্ত্র। 

এবার অভিনব উপায়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার দাবি আওয়ামী লীগের। সেটি করতে গিয়ে দলের বিভাজন-বৈরিতা ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীদের ভাষাভঙ্গি বিরোধী দলের নেতাদেরও ছাড়িয়ে গেছে। কেউ বলছেন, প্রতিপক্ষ তাঁর বিজয় ডাকাতি করে নিয়েছে। কারও দাবি, প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যালট পেপারে ইচ্ছেমতো সিল মেরে তাঁকে হারানো হয়েছে। 

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জেলায় জেলায় সফর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বুধবার এক দলীয় সভায় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কৌশলের অংশ হিসেবে। জয়-পরাজয় যা-ই হোক না কেন, এখন ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। কোথাও সহিংসতা হলে দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া হবে না। নির্বাচনের আগেও এ রকম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। কাজ হয়নি।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো উত্তম পথ নয়। কিন্তু রাজনীতিকদের অনাস্থা–অবিশ্বাস যখন চরমে পৌঁছে যায়, যখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণের কোনো পার্থক্য থাকে না, তখন এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে উপায় কী? 

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় চারজন নিহত হয়েছেন। আহত শতাধিক। সহিংসতায় বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় উভয় পক্ষের প্রায় সবাই নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক। বিবিসির ভাষ্য, শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

দলের বিভেদ কমাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার কথা ভাবছেন বলে ডেইলি স্টার খবর দিয়েছে। তবে তাঁদের এই ভাবনা বাস্তবায়ন হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে বিএনপির নির্বাচনে আসা না আসার ওপর। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও যদি বিএনপি বর্জন করে, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যদি বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা কম।  

আওয়ামী লীগের নেতারা যখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলে অভিহিত করছেন, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এর গলদ ও অপূর্ণতার কথা অকপটে স্বীকার করলেন। পূর্বসূরি কে এম নূরুল হুদার মতো তিনি সবকিছু ভালো বলে সার্টিফিকেট দেননি।

বৃহস্পতিবার ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন’ অনুষ্ঠানে সিইসি খেদের সঙ্গে বলেন, নির্বাচনব্যবস্থার ওপরে জনগণের আস্থা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। নির্বাচনপদ্ধতিতে যদি আরও বেশি সংস্কার আনা যায়, যেখানে দৃশ্যমানভাবে আরও বেশি স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, তাহলে হয়তো আগামী নির্বাচনগুলো জনগণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। (মানবজমিন, ১৯ জানুয়ারি ২০২৪)

তিনি স্বীকার করেন, ‘কোনো নির্বাচনই কিন্তু বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নাই। এবারকার যে নির্বাচনটা নিয়ে খুব সন্তুষ্ট বোধ করছি হয়তোবা আমরা। আবার বলতে হবে এই নির্বাচনটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি।’

হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনে ত্রিমুখী চাপের কথা বলেন। আমরা ধরে নিতে পারি, একটি চাপ ছিল বিরোধী দলের, আরেকটি চাপ বিদেশিদের। তৃতীয় চাপটি কি সরকারের কাছ থেকে? নির্বাচনটি যে মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে, তার কৃতিত্ব যতটা না কমিশনের, তার চেয়ে বেশি বিরোধী দলের। বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৪–এর মতো প্রতিহত করতে যায়নি। যদিও তারা অবাস্তব অসহযোগের ডাক দিয়েছিল। 

সিইসি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন রাজনীতি সম্পর্কে, ‘রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই মোকাবিলা করতে হবে। তাঁরা যদি সেটা করতে ব্যর্থ হন, দেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।’ 

এর মাধ্যমে তিনি স্বীকার করলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট কাটেনি। সেই সংকট যেমন নির্বাচন কমিশন কাটাতে পারবে না, তেমনি পারবে না সমাজের অন্য শ্রেণি ও পেশার মানুষও। এটা কাটাতে হবে রাজনীতিকদেরই। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় দেশ ও জনগণের কল্যাণ, তাহলে তাঁরা একসঙ্গে বসে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না কেন? 

সিইসি নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাজনীতিকদের অনাস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি তা হলো রাজনীতিকেরা জনগণের প্রতিই আস্থা রাখতে পারছেন না। যদি রাখতে পারতেন, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ এই কথা বিশ্বাস করতেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে দশকের পর দশক সংঘাত হতো না। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কোনো উত্তম পথ নয়। কিন্তু রাজনীতিকদের অনাস্থা–অবিশ্বাস যখন চরমে পৌঁছে যায়, যখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণের কোনো পার্থক্য থাকে না, তখন এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা না করে উপায় কী? 

ভুয়া ভোটার তালিকা সংশোধনের জন্য আমরা ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করলাম। কিন্তু সব দল মিলে নির্বাচনটি করতে পারলাম না। নির্বাচন কমিশন গঠনে এত দিন কোনো আইন ছিল না। আইন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। কিন্তু বিরোধী দল সেটা মেনে নিল না। নির্বাচনে যাওয়া দূরের কথা, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে তাদের দাবিদাওয়া জানানোরও প্রয়োজন বোধ করল না। বিএনপি আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেও আওয়ামী লীগ একই ধারণা পোষণ করত।  

আসলে আমাদের রাজনীতির রোগটা অনেক গভীরে। সেটা সারাতে না পারলে কোনো নির্বাচনী সংস্কারই কাজে লাগবে না। 

রাজনীতিকেরাই দেশ চালাবেন। জনগণের কল্যাণে নীতি-পরিকল্পনা নেবেন। কিন্তু এই রাজনীতিকেরা যদি একে অপরকে ‘মহা শত্রু’ ভাবেন, সারাক্ষণ প্রতিপক্ষের ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘চক্রান্ত’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে তাঁরা দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করবেন কখন? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com