মতামত

মন্ত্রিপরিষদের কার্যালয় থেকে কুড়িগ্রাম কত দূর

মোহন্ত দাসের চোখের সামনেই দখল হয়ে গেছে নদী। দখলদার ও ইজারাদারের ভয়ে এখন তিনি নদীতে নামতে পারেন না।
 ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায় চাকিরপশার নামে একটি প্রবাহ আছে। সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়িতে উৎপন্ন হয়ে উলিপুরের থেতরাই নামক স্থানে তিস্তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর পরিচিতি কোথাও চাকিরপশার, কোথাও মরা তিস্তা, কোথাও বুড়িতিস্তা। এই প্রবাহের মধ্যবর্তী পাঁচটি মৌজা চাকিরপশার বিল শ্রেণিভুক্ত। বিলের অংশে প্রবাহ বন্ধ করে আড়াআড়ি সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার একর তিন ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতাজনিত অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইরি-বোরো উভয় মৌসুমে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। সড়কটি পাকা করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

চাকিরপশার সুরক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন, রংপুর বিভাগীয় প্রশাসন, ভূমি মন্ত্রণালয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু চাকিরপশারের জমি বন্ধক রেখে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ, এমনকি বন্ধক থাকা অবস্থায় বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। দুদক এ বিষয়ে কাজ করছে। অমৎস্যজীবীদের লিজ দেওয়া, লিজ বাতিল করার মতো ঘটনাও আছে। উন্মুক্ত জলপ্রবাহকে বদ্ধ জলাশয় ঘোষণা করে সায়রাতভুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমান জেলা প্রশাসন প্রায় ৩০৬ একরের মধ্যে ১৪১ একরকে উন্মুক্ত ঘোষণা করেছে এবং সায়রাতভুক্তি থেকে বাতিল করেছে। গায়ের জোরে কয়েকজন প্রভাবশালী এখনো সর্বসাধারণকে নামতে দিচ্ছেন না।

যখন যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, তখন তারা খুবলে খুবলে চাকিরপশারকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করেছে। এসবের বিরুদ্ধে রিভারাইন পিপল, গণকমিটি গড়ে তুলেছে আন্দোলন। অবৈধ দখলদারেরা অনেকেই দলীয় পরিচয় ভুলে অবৈধ দখলদার সূত্রে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলেছে। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তারা সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন করার কাজ করেছে। আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও কম হয়নি। এমনকি চাকিরপশাখেকো কর্তৃক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আন্দোলনকারী-কলাম লেখক, প্রতিবেদক, বার্তা সম্পাদক ও সম্পাদকের নামে মামলারও আবেদন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা জনস্বার্থমূলক মামলায় উচ্চ আদালত অবৈধ দখল উচ্ছেদের নির্দেশনা দিয়েছেন। অমৎস্যজীবীদের লিজ দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না, তা–ও উচ্চ আদালত জানতে চেয়েছেন। নতুন রেকর্ডে কয়েকটি মৌজায় সরকারের সম্পত্তি ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়েছে। সেই রেকর্ড সংশোধনের জন্য শতাধিক মামলা করেছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন। উপজেলা ভূমি কার্যালয় ওই মৌজাগুলোর জমির খাজনা নেওয়া বন্ধ করেছে। বেচাকেনাও বন্ধ আছে।

চাকিরপশারের বহুবিধ সংকট যেমন আছে, তেমনি সংকট থেকে উত্তরণের নানা মাত্রিক চেষ্টা বিদ্যমান। এসব চেষ্টার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১২ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সংযোগ অধিশাখা থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে। সেখানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কথা উল্লেখ করে আড়াআড়ি সড়কে সেতু স্থাপনের বিষয়ে বলা হয়েছে। উজানে হাজার হাজার একর জমিতে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে এবং প্রবাহ সচল রাখতে এই নির্দেশনা। নির্দেশনাটি চাকিরপশারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে সাত মাস পেরিয়ে গেলেও ওই চিঠি এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রামের এলজিইডি পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।

মন্ত্রিপরিষদের এই চিঠি ঢাকা থেকে ডাক বিভাগের মাধ্যমে আসবে না। আসবে অনলাইনে। মিনিট-সেকেন্ডের ব্যাপারমাত্র। সেই মিনিট-সেকেন্ডের চিঠি সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কুড়িগ্রাম এসে পৌঁছায়নি। মন্ত্রিপরিষদের এই চিঠি আমলে নিয়ে যদি কাজের অগ্রগতি থাকত, তাহলে হাজার হাজার একর জমির মালিককে দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো না। দেশে যখন প্রধানমন্ত্রী বারবার করে বলেন এক ইঞ্চি জায়গাও যেন পতিত না থাকে, তখন হাজার হাজার একর ফসলি জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। প্রবাহ বাধাহীন করার সব নির্দেশনাই এখানে অকার্যকর। সরকারিভাবেই এর চরম সর্বনাশ করা হয়েছে।

সাত মাস পরও যদি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠি আমলে নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ শুরু করে, তবু নদীটি বাঁচবে, প্রবাহ ঠিক থাকবে, হাজার হাজার একর জমির ফসল ফলানোর অনিশ্চয়তা দূর হবে। একটি প্রবাহ বন্ধ করে যারা পাকা সড়ক বানিয়েছে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা নেই, সরকারি জমি ব্যক্তির নামে যাঁরা লিখে দিয়েছেন, তাঁরাও আছেন নিরাপদে, ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের যাঁরা সরকারের জমি ব্যক্তির নামে লিখিত হওয়ার কারণে রেকর্ডেও ব্যক্তির নামে করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। চাকিরপশারের আজ এ অবস্থায় আসার জন্য সরকারি অনেক ব্যক্তি দায়ী। শুরু থেকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে চাকিরপশার আজ এতটা সংকটে পড়ত না।

উচ্চ আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের নদীগুলোর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। এই কমিশনের তদন্ত দল সরেজমিন তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারও বাস্তবায়ন নেই। চাকিরপশারের সব অবৈধ দখল উচ্ছেদপূর্বক এর প্রাণপ্রবাহ ফেরাতে পারলে সেটিও একটি বড় দৃষ্টান্ত হবে। বর্তমান জেলা প্রশাসক আন্তরিক। কিন্তু আড়াআড়ি সড়কে সেতু স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ স্থানীয় সরকার বিভাগকেই গ্রহণ করতে হবে। নদীপারের মানুষ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে চাকিরপশারে প্রবাহ ফিরবে এবং মুক্ত হবে—সেটি দেখার জন্য।

কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা। অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, এ জেলার জন্য দেশে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি দেশের বৈষম্য নিরসনে এবং কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য-তিলক দূরীকরণে কাজ করতে পারেন। চাকিরপশারের ক্ষেত্রেও কি সেটাই আমাদের মনে করতে হবে?

● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com