মতামত

স্বাধীন দেশেই খোকারা গুম হয়ে যাচ্ছে

আন্তর্জাতিক গুম-খুন দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়া পল্টন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে কর্মসূচি। ৩০ আগস্ট, মঙ্গলবার
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পারে দাঁড়িয়ে
এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে
খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না’

গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথায় ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে প্রখ্যাত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে বহুলশ্রুত একটি কালজয়ী গান। এ গানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, গুম হওয়া লাখো খোকার গল্প বলা হয়েছে। যাঁরা স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য, নিজস্ব পতাকার জন্য, নিজস্ব পরিচয় গঠনের জন্য, একটি মুক্ত মানচিত্রে মুক্তভাবে কথা বলার জন্য, স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, তাঁদের নিয়ে এ গান। তাঁরা অকাতর জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ বীরদর্পে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। কাউকে কাউকে পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনী ধরে নিয়ে গুম করেছিল। নির্মম নির্যাতনের পরও মুখ খোলেননি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে। এ রকম অমিত সাহসী সূর্যসন্তানদের জন্য জাতি আজীবন অপেক্ষা করে, যাঁরা স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে শত্রুপক্ষ থেকে ছিনিয়ে হাতে নিয়ে ঘরে ফিরবেন। প্রবল জনপ্রিয় এ গানে হারিয়ে যাওয়া সেসব বিপ্লবী ও সাহসী খোকার জন্য মা-বাবা, ভাই-বোন ও সন্তানদের হাহাকার, ফিরে পাওয়ার আকুতিই ফুটে উঠেছে।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫১ বছর। কিন্তু স্বাধীন দেশেই এখন খোকারা হারিয়ে যাচ্ছে। গুম হচ্ছে। খোকাদের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষার প্রহর গুনছে মা, বাবা, সন্তান, ভাই ও বোনেরা। ঠিক যেন এ গানের মতোই। ওরা কি ফিরবে, নাকি ফিরবে না। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ থেকে ওরা গুম হয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই, ওরা একটি রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে গায়েব হয়ে গেছে। ওদের কোনো হদিস মিলছে না।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের হত্যা করেছিল। গুম করেছিল। স্বাধীন দেশের এখন কারা গুম করছে? বিচারবহির্ভূত হত্যা করছে। রাতের বেলা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রাতের গভীরে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো কারা ঠকঠক করে দরজায় কড়া নাড়ছে। কারা এই গুমের হিমশীতল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে গুমের অভিযোগের আঙুল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে উঠেছে। সম্প্রতি নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, গুমের সঙ্গে একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী জড়িত। এর পাশাপাশি র‍্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেও গুমের অভিযোগ রয়েছে। গুম থেকে ফিরে আসা দুজন জানিয়েছেন, বিরোধী মতের লোকদের ধরে নিয়ে ‘আয়নাঘর’ নামের একটি গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রাখা হচ্ছে।

গত ৩০ আগস্ট ছিল জাতিসংঘঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণ ও গুম প্রতিরোধ করতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল নাগাদ গুমবিরোধী সনদ রচনা করে, যা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স নামে পরিচিত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯৮টি দেশ এই কনভেনশনের স্বাক্ষর করেছে এবং ৬৭টি দেশের সংসদ এই কনভেনশনের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করছে বা রেটিফাই করেছে।

বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। উপরন্তু, গত এক দশকে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবমতে, ৬০৫ জন বা এর বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন দেশে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গুমের অভিযোগের আঙুল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে উঠেছে। সম্প্রতি নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, গুমের সঙ্গে একটি বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী জড়িত। এর পাশাপাশি র‍্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেও গুমের অভিযোগ রয়েছে। গুম থেকে ফিরে আসা দুজন জানিয়েছেন, বিরোধী মতের লোকদের ধরে নিয়ে ‘আয়নাঘর’ নামের একটি গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রাখা হচ্ছে।

অবশ্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গুমের বিষয়টি স্বীকার করতে চান না। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্যমতে, ব্যবসায় লোকসানের মুখোমুখি হয়ে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। তাঁদের গুম করা হয়েছে বলে অপপ্রচার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। তবে সরকারের দায়িত্বশীল দু-একজন আরও বলেছেন, ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকেরই ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে। সাগরে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিদের গুম হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

আমরা প্রবাসীদের আয় নিয়ে গর্ব করি। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য আহ্বান জানাই। একই সঙ্গে আমরা জানি, এই প্রবাসীরা বিশেষ করে ইউরোপে অভিবাসীরা কীভাবে পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে পাড়ি জমান। ইউরোপে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের ন্যূনতম কোনো সহযোগিতা নেই। নিজ অর্থে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা পাহাড়, জঙ্গল ও সাগর পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছান সোনার হরিণের আশায়। তাই তাঁদের নিয়ে গুমের মতো একটি ভয়ংকর বিষয়ে ঠাট্টাতামাশা করা অত্যন্ত স্থূল রুচির পরিচয়।

সরকারি দল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই গুমের বিষয়টি বালখিল্য আচরণ ও কথাবার্তা বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও উদোর পিণ্ডি বিএনপি নামক বুধোর ঘাড়ে চাপাতে গিয়ে সত্য কথাটা বলে ফেলেছেন দলটির দু-একজন নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রথমে বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও এখন বলছেন, আয়নাঘর বিএনপির সৃষ্টি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে ‘আয়নাঘর’ আছে। এর কোনো অস্তিত্ব যদি না-ই থাকে, সরকার যেহেতু বলছে কাউকেই গুম করা হয়নি, বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে না; বিদেশে বসে অনেকেই বিদেশি গোয়েন্দাদের অর্থে দেশের বদনাম করছে। তবে সরকারেরই উচিত হবে শুধু অভিযোগ করেই চুপ না থেকে এর একটি স্বচ্ছ তদন্ত করা। সরকার নিজেই তদন্ত করলে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে। তাই সরকার একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের মাধ্যমে এ অভিযোগের সুরাহা করতে পারে।

আর ওদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে সাহায্য করার জন্য সব সময়ই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার মিশেলে ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্ত করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে সরকারকে তাঁর অফিস সহায়তা করতে প্রস্তুত। তিনি গুম প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটি দেশে আসতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ব্যাশেলেত কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলেছেন। এ ধরনের ট্রান্সন্যাশনাল কূটনীতিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এর থেকে সরাসরি কিছু বলা হয় না। এভাবে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। জাতিসংঘ যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তবে সামনে জটিলতা বাড়তে পারে। সরকারের উচিত হবে ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়াতেই হোক আর কথিত ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্যই হোক, জাতিসংঘের লোকদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা তদন্তের জন্য আসতে দেওয়া। শুধু শুধু সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা লোকজন অহেতুক সন্দেহ ও অভিযোগের দায় মাথায় বয়ে বেড়াবে কেন। অতিসত্বর সরকারের উচিত এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া। এতে সরকারেরই লাভ হওয়ার কথা। তাদের দায়মুক্তি ঘটবে। অন্তত সরকারের যুক্তি অনুসারে তা-ই মনে হয়।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক