এই দফায় প্রিন্স মামুনকে নিয়ে চর্চার কারণ তিনি তাঁর বন্ধু লায়লাকে ঘুষিয়েছেন।
এই দফায় প্রিন্স মামুনকে নিয়ে চর্চার কারণ তিনি তাঁর বন্ধু লায়লাকে ঘুষিয়েছেন।

মতামত

দোষ কি প্রিন্স মামুন ও লায়লার, না আমাদের কপালের?

প্রিন্স মামুন ও লায়লা যা করছেন, তা-ই হিট। প্রিন্স মামুন কিশোরগঞ্জে যাচ্ছেন, লায়লাকে নিয়ে টঙে খাচ্ছেন, ফেরদৌস-পূর্ণিমা ও পল্লবী থানার ওসিকে পেছনে রেখে টিকটক করছেন, বাহারি গাড়িতে চড়ছেন, প্যারাগ্লাইডিং করছেন, মাদক সেবনের টিউটরিয়াল দিচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষ তাঁদের দেখছেন, লাইক-কমেন্ট-কনটেন্ট শেয়ার করছেন। এই দফায় প্রিন্স মামুনকে নিয়ে চর্চার কারণ তিনি তাঁর বন্ধু লায়লাকে ঘুষিয়েছেন।

লায়লা কাঁদো কাঁদো গলায় সেই খবরের ভিডিও আপলোড করেছেন। পরে অবশ্য তাঁদের মিটমাট হয়ে যায়। এই জুটির ঘুষাঘুষি ও মিটমাট পর্বকে ঘিরে জাতি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দোষ কার? প্রিন্স মামুনের? লায়লার? আমাদের কপালের দোষ কি না, সে প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।

প্রশ্ন বিভিন্ন ধরনের ও নানামুখী। তবে একটা বিষয়ে ঐকমত্য আছে, তা হলো প্রিন্স মামুন ও লায়লার মতো টিকটকারদের প্রায় অর্থহীন শর্টস ও রিল কিশোর-তরুণেরা গোগ্রাসে গিলছেন। শুধু গিলছেন বললেও ভুল হবে। টিকটকারদের ফলোয়াররা সময়-সময় ‘ডে আউট’ করছেন। আপনাদের একাধিক ঘটনা মনে থাকার কথা।

টিকটক অপু ও তাঁর ফলোয়াররা খবর হয়েছিলেন মারপিট করে। আর রিফাদুল ইলাম ওরফে টিকটক হৃদয় (২৬) কিশোরীদের ভারতে পাচার করে। ভারতে একটি বীভৎস ধর্ষণের ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়লে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছিল।

টিকটক হৃদয় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের আকর্ষণীয় লোকেশনে নিয়ে গিয়ে জনপ্রিয় টিকটকার বানিয়ে দেবেন, এমন রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে পাচার করে দিচ্ছিলেন।

তাই বলে আয়মান সাদিকদের ফলোয়ারের সংখ্যা কিন্তু কম না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন বা বিরোধীদের ফলোয়ারও কম না। তার ওপর ‘সুপার অ্যাচিভার’রা আছেন। এই তরুণেরা নিয়মিত বিরতিতে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, প্রশ্ন করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ তাঁরাই নাকি এগিয়ে নেবেন।

আসল কথা হলো, বাংলাদেশের কিশোর-তরুণেরাও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কিশোর-তরুণদের মতো রিলস বা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিওতে আসক্ত হয়ে উঠেছেন। এতে প্রিন্স মামুন, লায়লা বা আমাদের কপালের দোষ নেই।

যা নিয়ে আলোচনা জরুরি, তা হলো এসব শর্টস বা রিলের কোনো নেতিবাচক প্রভাব আমাদের বৃহত্তর জীবনে পড়ছে কি না। আমাদের নীতিনির্ধারকদের কিছু করার আছে কি না। কারণ, সব সময় এ ধরনের ভিডিওর প্রভাব ইতিবাচক না–ও হতে পারে।

এমনকি কোথাও কোথাও রাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ নিয়ে গত বছর থেকে একরকম তোলপাড় চলছে। আমরা ওয়াশিংটন পোস্ট ‘হাউ টিকটক অ্যাট দ্য ইন্টারনেট’ নামের প্রতিবেদনটির কথা ভাবতে পারি। কিংবা কংগ্রেসের শুনানির প্রসঙ্গ টানতে পারি।

ক্লাউডফেয়ার, ডাটা এ আই এবং সেন্সর টাওয়ারের হিসাবে গত বছর গুগলের চেয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা টিকটকে ঢুঁ দিয়েছেন বেশি। সবচেয়ে দ্রুত ১০০ কোটি গ্রাহক পেয়েছে অ্যাপটি, যার ১০ কোটির বসবাস যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতিবেদনে অ্যাবি রিচার্ডস নামে এক গবেষকের উদ্ধৃতি আছে।

তিনি বলছেন, এই প্ল্যাটফর্ম পৃথিবীতে কী ঘটছে তার সম্পর্কে গোটা প্রজন্মের ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে। টিকটকের বিরুদ্ধে কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে সিইও শোও চিউকে হাজির হতে হয়েছিল কংগ্রেসের সামনে। এই প্ল্যাটফর্মের কারণে কিশোর-তরুণেরা আত্মঘাতী হচ্ছেন, নিজেদের আঘাত করে বা তাঁদের খাওয়াদাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, এমন হাজারো অভিযোগ। টিকটক তাদের প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করে সমালোচনার মুখে।

বিশ্বজুড়ে আরও যে বিষয়টি এখন আলোচনায়, তা হলো কিশোর-তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। ফ্রিডম হাউস জাতিসংঘের একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ৭৬ শতাংশ তরুণ বলেছেন, তাঁদের নিয়ে রাজনীতিকেরা চিন্তা করেন না। তাই তাঁরা রাজনীতিবিমুখ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একটি আসনের আশায় যে ছাত্রটি রাজনীতিতে জড়ায়, সে শেষ পর্যন্ত রাজনীতি না–ও করতে পারে। কারণ, জীবন-যৌবন দিয়ে রাজনীতি করে লাভ নেই। শেষ কবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া কোনো উজ্জ্বল ছাত্রনেতা সংসদ সদস্য হয়েছেন, মনে পড়ে না। সংসদ ব্যবসায়ী আর তারকাখচিত। তাই নগদ যা পাও হাত পেতে নাও স্টাইলে চলে ছাত্র (অপ) রাজনীতি।

বুদ্ধিবৃত্তিক এই সংগঠনটির মত হলো, আগের প্রজন্ম কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর বিপক্ষে যত সোচ্চার ছিল এখনকার ছেলেমেয়েরা ততটা নয়। তারা কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান গড়ে তুলেছে এবং অধিকতর রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে এনেছে।

কিন্তু এখনকার তরুণদের এই রাজনীতিবিমুখতা ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা, সিদ্ধান্ত যারা নেয়, তাদের জবাবদিহির আওতায় কীভাবে আনা যায়, সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ডিজিটাল স্পেস এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আমার মনে হয়, আমাদের কিশোর-তরুণেরা এই বৈশ্বিক ঢেউয়ের বাইরে নেই। পার্থক্য একটাই। তা হলো বিশ্বের সভ্য, উন্নত দেশগুলো এসব নিয়ে ভাবছে। আমাদের দেশের কিশোর–তরুণদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকার জানে কি না, তা সবাই জানে না।

আমরা বড়সংখ্যক কিশোর-তরুণদের রুচি-সংস্কৃতির বোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, বলছি হিরো আলম তাঁদের স্ট্যান্ডার্ড। তারা গ্যাং বানিয়ে দুর্বৃত্তপনা করে। কিন্তু তাদের পথ দেখাবে কে? কেউ কি দেখাতে চায়? এ জন্য এ দেশের রাজনীতিহীনতা বা অপরাজনীতিকে দোষ দিলে কি গুনাহ হবে?

হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একটি আসনের আশায় যে ছাত্রটি রাজনীতিতে জড়ায়, সে শেষ পর্যন্ত রাজনীতি না–ও করতে পারে। কারণ, জীবন-যৌবন দিয়ে রাজনীতি করে লাভ নেই। শেষ কবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া কোনো উজ্জ্বল ছাত্রনেতা সংসদ সদস্য হয়েছেন, মনে পড়ে না। সংসদ ব্যবসায়ী আর তারকাখচিত। তাই নগদ যা পাও হাত পেতে নাও স্টাইলে চলে ছাত্র (অপ) রাজনীতি।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী কেন পদ হারিয়েছিলেন, মনে আছে তো? এই আমলের সবচেয়ে বড় আন্দোলন ছিল গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। ইমরান এইচ সরকার বা নুরুল হক নূররা কি শেষ পর্যন্ত জ্বলে উঠতে পারলেন?

অথচ তরুণেরা যদি রাজনীতিতে যুক্ত থাকতেন, তাহলে শিশু-কিশোর-তরুণদের দেখভালের দায়িত্ব যে সংস্থাগুলোর, তারা কি এভাবে পার পেয়ে যেত? না।

শিশু-কিশোরদের নাচ-গান-ছবি আঁকা ইত্যাদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে। সারা দেশের কত শিশুর কাছে শিশু একাডেমি পৌঁছাতে পেরেছে? গড় হিসাবে ঢাকায় শিশুর সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। এর মধ্যে শিশু একাডেমির প্রশিক্ষণের আওতায় এসেছে মাত্র চার হাজার।

স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেলাধুলা নিয়ে বেশ একটা উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল। ধরে রাখা গেল কি? হঠাৎ শোনা গেল, মেয়ে ফুটবলাররা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। তাদের না হয়েছে লেখাপড়া, না খেলাধুলা।

জেলায় জেলায় স্টেডিয়াম হয়েছে। এই তো সেদিন প্রথম আলোর মাগুরা প্রতিনিধি জানালেন ইনডোর স্টেডিয়াম তালাবদ্ধ থাকে। খেলোয়াড়েরা অনুশীলন করতে পারেন না। কমলাপুর স্টেডিয়ামে হয়েছে রিকশার গ্যারেজ। আপনার আমার টাকার বড় অংশ পকেটে পুরে আর কিছু মাঠে ঢেলেই কিন্তু এই স্টেডিয়ামগুলো তৈরি হয়েছে। অথচ তারা সব রকম জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে গেল।

স্কাউট, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে কতটা কাজে লাগানো গেল? আমাদের কিশোর-তরুণেরা অমিত সম্ভাবনাময়। রানা প্লাজা ধসের পর স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে একটা পুল করার কথা ছিল। সেই পুলের কী হলো?

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী। ধরুন, নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নতুন ভোটার হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ তরুণ-তরুণী। তাঁদের কত শতাংশ ৭ জানুয়ারি ভোট দিতে যাবেন, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

রাজনীতিতে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলে কিশোর-তরুণেরা কখনো টিকটক অপু, কখনো হৃদয় আবার কখনো প্রিন্স মামুনে মত্ত থাকবে। আর সুবোধেরা পালিয়ে বেড়াবে। কারণ, সময় তাঁদের পক্ষে না।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com