মতামত

বিএনপি কি আদৌ খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়?

মূলত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি কোনো কার্যকর আন্দোলন ও কৌশল নির্ধারণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ছবি: প্রথম আলো

খালেদা জিয়ার কারান্তরিণ হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। খালেদা জিয়ার কারাগারের জীবন দীর্ঘায়িতই হয়েছে। শুরুর দিকে নাজিমউদ্দিন রোডের নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারা বিভাগ ঘুরে এখন নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়েছে। তিনি ঘরের বাইরে যেতে পারেন না। প্রকাশ্যে কোনো কথাবার্তা বলেন না। তবে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান। কিন্তু বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি মেলেনি। তবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির নেতারা দেখা করতে পারেন বিভিন্ন সময়ে।

কাগজে–কলমে খালেদা জিয়া এখনো বিএনপির চেয়ারপারসন। কিন্তু তিনি কোথাও নেই। সমাবেশের বাইরে তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনাও করে না বিএনপির নেতারা। খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কমবেশি সব সমাবেশেই বিএনপির নেতারা গরম গরম কথা বলেন। কিন্তু বক্তৃতার মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর সবাই আগের মতোই সবকিছু ভুলে যান। মূলত খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি কোনো কার্যকর আন্দোলন ও কৌশল নির্ধারণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

দেশের ভেতরে ও বাইরে সব জায়গাতেই একই অবস্থা। বিএনপির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় খালেদা জিয়ার কারান্তরিণ হওয়ার ৫ বছরে কোনো প্রতিবাদী কর্মসূচি আছে কি না, তা খুঁজে দেখলাম। কোথাও কিছু পেলাম না। থাকতে পারে। কিন্তু আমার মতো অনেকের নজরে আসেনি। কী বিস্ময়কর! কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।

বিএনপি মনে করে, খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক কারণে কারাগারে রেখেছে আওয়ামী লীগ। তাহলে এই অন্যায় ও অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হতে বিএনপির ভয় ও দ্বিধা কেন? কখনো মনে হয় এতে অবাক হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিশাল মিছিলের বহর নিয়ে রীতিমতো কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। আদালতে কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর কোথাও তেমন কড়া প্রতিক্রিয়া আসেনি বিএনপির পক্ষ থেকে। এ কারণেই আওয়ামী লীগের লোকজন ঠাট্টা করে বলে, ‘বিএনপি মিছিল করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে।’

কারাগারে নেওয়ার দিন বিএনপি যেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি তেমনি এরপরও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপির রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপি আইনি লড়াইয়ের দিকে গিয়েছে। রাজনীতিতে পরিস্থিতির আগাম অনুমান করা জরুরি বিষয় এবং পক্ষ নির্ধারণ করারও জরুরি। কখন কার পরামর্শ গ্রহণ করতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্বের প্রশ্নে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাতে দুটি পথ ছিল। এক, কর্নেল তাহের ও জাসদের পরামর্শ শুনে শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষণ দেওয়া। আরেকটি ছিল, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুসারে সেনানিবাসে বসে ভাষণ ধারণ করে রেডিও–টেলিভিশনে প্রচার করা। জিয়া প্রথম পরামর্শ অনুসরণ করেননি। দ্বিতীয় পথ অনুসরণ করে তিনি আজ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম চরিত্র। আর শহীদ মিনারে গেলে ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। এমনকি জিয়ার নাম–নিশানাও মুছে যেতে পারত দেশের ইতিহাস থেকে।

বর্তমান বিএনপিকেও কৌশল প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিয়ার মতো দক্ষ ও মেধাবী হতে হবে। খালেদা জিয়ার শাস্তিকে যদি বিএনপি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে মনে করে থাকে তবে তাঁর মুক্তির রাজনৈতিক কৌশলও নিতে হবে। এটা শুধু আদালত ও বিচারব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে বসে থাকার বিষয় নয়। খালেদা জিয়া যে এখন কারাগারের বাইরে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন, এটাও আদালতের সিদ্ধান্ত নয়। তিনি বাড়িতে আছেন নির্বাহী সিদ্ধান্তে। বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোন বিবেচনায় শুধু আইনি লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করে আছে সেটা দলটিকে ভেবে দেখতে হবে।

শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিএনপির খালেদা জিয়ার বিষয়টি তুলে ধরতে পারেনি। বিএনপি তো দাবি করে, খালেদা জিয়া সুবিচার পাননি। বিদেশে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুবিধা নিতে পারছেন না, তাঁর ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। যদি তাই হয় তবে বিএনপি কেন জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার কাছে এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারল না? খালেদা জিয়ার মানবাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে থেকে সরকারকে চাপ দিয়ে কোনো বিবৃতি কেউ দিয়েছে বলে জানা নেই।

মূলত, বিএনপির নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বল অবস্থানের কারণে যখন-তখন খালেদা জিয়াকে আবারও কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। খালেদা জিয়ার ভাগ্য এখন অনেকটা আওয়ামী লীগের হাতে নির্ধারিত হয়।

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কার্যকর কৌশল ও নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণ কী? প্রথম কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য ও অদক্ষতা। আর দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত বিএনপির একটি অংশের নিজস্ব সুবিধার চেষ্টা।

এটা খালেদা জিয়ার জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। এর আগে রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কোনো ধরনের পূর্বাভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি দল ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে এক হাতে সামনে টেনে নিয়ে যান। দৃঢ় অবস্থানের কারণে তিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অথচ জীবন ও রাজনীতির এক ক্রান্তিকালে এসে দেখলেন, তাঁর চারপাশে আপসকর্মী লোকজনের ভিড় প্রবল।

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কার্যকর কৌশল ও নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণ কী? প্রথম কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য ও অদক্ষতা। আর দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত বিএনপির একটি অংশের নিজস্ব সুবিধার চেষ্টা। সুবিধা পাওয়ার বিনিময়ে তার হয়তো খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘ট্রেড অফ’ করেছে। মানে খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগের কাছে ‘বিক্রি’ করে দিয়েছে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক