অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে
অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে

মতামত

শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে অনূঢ়া সুনামি, বড় চ্যালেঞ্জ সামনে

দুই মাস আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চমকপ্রদ জয়লাভ করেছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। সেই বিজয়ের পর ১৪ নভেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের (এনপিপি) ব্যাপক দুই-তৃতীয়াংশ বিজয়ও কম চমকপ্রদ নয়। এই নির্বাচনে তামিল ও মুসলিম জনগণ এনপিপিকে যে অভূতপূর্ব সমর্থন দিয়েছে, তা–ই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? 

প্রথম নির্বাচনের অল্প পরেই দ্বিতীয় নির্বাচন হলে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তবু অনেকেই হিসাব-নিকাশ করে সংসদে এনপিপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। দৃশ্যত, এ কারণে তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের কৌশল নিয়েছিল দলটি। কিন্তু তাই বলে দলটি ১৫৯টি আসন পাবে, তা বোধ হয় কেউ ভাবেনি।

তামিলদের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত জাফনা উপদ্বীপের ভোটারদের মধ্যে এনপিপি প্রথম হলো। একইভাবে শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেস তাদের দুর্গ কালমুনাইতে এনপিপির কাছে পরাজিত হয়েছে। তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন করে হৃদয় পরিবর্তনটি বাইরের লোকদের কাছে বিভ্রান্তিকর। তবে এই দুটি সম্প্রদায়ের নেতারা সাধারণ নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে এমন একটি বিপদ আঁচ করেছিলেন।

কিছু তামিল নেতা তাই তাঁদের সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ব্যবস্থা বদলের যে আহ্বান দক্ষিণ জানাচ্ছে, তামিল জাতীয়তাবাদকে সেখানে বিলীন হতে দেবেন না। 

মুসলিম নেতারাও নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিলেন, ব্যবস্থা পরিবর্তনের নামে মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন নির্মূল হয়ে না যায়। এমনকি এনপিপির বিরুদ্ধে জাতিগত সংবেদনশীল মিথ্যা অভিযোগও ছড়ানো হয়েছিল। তবু দুটি সম্প্রদায় নেতাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সিংহলি সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন ছিল পরিমাণগত। তবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটেছে পরিমাণগত ও গুণগত উভয়ভাবেই। তামিল নেতাদের দাবি অনুযায়ী, ফেডারেল ব্যবস্থা প্রবর্তন, উত্তর ও পূর্ব প্রদেশের একীভূতকরণ এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। তা সত্ত্বেও এনপিপির আহ্বান গ্রহণ করেছে তামিল জনগণ।

এর আগে পার্লামেন্টে দুই–তৃতীয়াংশ বা ততোধিক আসন পেয়েছে একাধিক দল। কিন্তু কোনো দলই বর্তমান বিজয়ের জন্য জেভিপির মতো এত বড় ত্যাগ স্বীকার করেনি। গত ছয় দশকে অনূঢ়ার দল জেভিপির প্রতিষ্ঠাতা নেতা রোহানা বিজয়বীরসহ প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অতীতের দুটি সরকার পরিচালিত দুই রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নে প্রাণ দিয়েছেন। এ সপ্তাহে জেভিপি শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ক্ষমতার সঙ্গে শাসনক্ষমতায় ফিরে এল।

জেভিপি ১৯৯৪ সাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছে কোনো সাফল্য ছাড়াই। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনূঢ়ার জোট এনপিপির ‘বিপ্লব’ শুরু করার জন্য পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ায় অবদান রেখেছেন। তাঁর অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো এত দিন যেভাবে রাজনীতি করে এসেছে, জনগণ সেই ঐতিহ্যগত বন্ধন ভেঙে বের হয়ে আসে। ২০২২ সালের গণ–অভ্যুত্থানও এর জন্য সহায়ক ছিল। অবশেষে শ্রীলঙ্কার মানুষ জেভিপিতে একটি নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুঁজে পেয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে জেভিপি তার নীতিকাঠামোকে সমাজতন্ত্র থেকে সামাজিক গণতন্ত্রে পরিবর্তন করেছে। ব্যবস্থার বদল চায়—এমন কয়েক ডজন গ্রুপের সঙ্গে মিলে ২০১৯ সালে গঠন করে এনপিপি জোট। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই এই পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা উল্টো প্রশ্ন করেছেন, ‘৩ শতাংশের দল ৫০ শতাংশে পরিণত হবে কেমন করে?’ তাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা ধরতেই পারেননি।

গঠনের পর থেকে জেভিপি ৬০ বছর ধরে বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তবে এনপিপি নেতৃত্বের সামনে এখন তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। শ্রীলঙ্কা এখন এক দেউলিয়া দেশ। সে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র হাড়ে–মজ্জায় দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দেশকে এক করে প্রেসিডেন্ট অনূঢ়াকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সঙ্গে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে তাঁর আর তাঁর দলের ওপর আস্থা রাখা জনগণের। যত বড় বিজয়, প্রত্যাশার তত চাপ। এ এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলা।

মোহাম্মদ আইয়ুব শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক 

ডেইলি মিরর অনলাইন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত