আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি

খামেনির উত্তরাধিকারী নিয়ে সংকটে ইরান

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি গুরুত্বহীন পদে থাকা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পদটিকে গুরুত্বহীন বলা যায় এই অর্থে যে ইরানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে থাকে না; থাকে সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির হাতে।

আর থাকে ইরানের বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) হাতে, যারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামি শাসনব্যবস্থার দমনমূলক কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করে। আইআরজিসি হলো ইরানের শক্তিধর সেই প্রতিষ্ঠান, যেটি কিনা দেশটির অর্থনীতির নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ইব্রাহিম রাইসির অযোগ্যতা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ছিল। ১৯৮৮ সালে চার হাজারের বেশি রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যুদণ্ড তাড়াহুড়ো করে কার্যকরের ঘটনায় ভূমিকা রাখার জন্যও তিনি কুখ্যাত। বছর কয়েক আগে এ ঘটনা নিয়ে একবার কিছু খোলামেলা আলোচনা হয়েছিল। তখন ইব্রাহিম রাইসি বলেছিলেন, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের কলুষিত প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য তাঁর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া উচিত।

এটি সর্বজনস্বীকৃত যে খামেনির সিংহাসনের নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ পাওয়া ছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নেই। তবে অশীতিপর খামেনি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর উত্তরাধিকার কে হবেন, সেই প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট পদটি সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খামেনির উত্তরাধিকারী হওয়ার পথকে কার জন্য প্রশস্ত করা হচ্ছে এবং পছন্দসই সেই প্রার্থীর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছেঁটে ফেলা হতে যাচ্ছে, তা অনুমান করা এখন ইরানে একধরনের পারলার গেমে পরিণত হয়েছে।

ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেছিলেন, কেউ একজন আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে বলতে শুনেছেন যে খামেনি তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। রাফসানজানির ওই কথাকেই আয়াতুল্লাহ খোমেনির অসিয়ত হিসেবে ধরে নিয়ে খামেনিকে সর্বোচ্চ নেতৃত্বে বসানো হয়। এখন সমস্যা হলো, খামেনি এখনো তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কারও নাম বলেননি।

একজন নিম্নস্থানীয় বিচারক থেকে বিচার বিভাগের প্রধান হয়ে ওঠা এবং সেখান থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ পথ আমলে নিয়ে বিবেচনা করে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, রাইসিকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখন যেহেতু রাইসি মারা গেছেন, সেহেতু কেউ কেউ এখন খামেনির উত্তরাধিকার–সংকটের কথা বলছেন।

একদিকে খামেনির নিজের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা–সম্পর্কিত ধারণা এবং ইমাম হিসেবে তাঁর নিজেকে আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি ভাবা (একবার একটি খুতবায় তিনি বলেছিলেন, তাঁর মুখনিঃসৃত নসিহত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে) এবং অন্যদিকে রাইসির দুর্বল মেধার কুখ্যাতির কারণে, এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে খামেনি রাইসিকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি ভেবেছিলেন।

অন্যদিকে খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনি (দীর্ঘদিন জনসমক্ষে না আসার কারণে যাঁকে রহস্যময় ব্যক্তি হিসেবে ভাবা হয়) খামেনির স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন—এমন একটি গুঞ্জনও শোনা যায়। তবে পশ্চিমের কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, খামেনি বংশগত শাসনব্যবস্থাকে ঘৃণা করেন বলে বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে তিনি চান না তাঁর পুত্র তাঁর উত্তরাধিকারী হোক।

কিন্তু খামেনির আচরণ ও শিয়া মতানুসারীদের ভাষ্য এ ধারণাকে খারিজ করে দেয়। খামেনি হলেন সেই নেতা, যাঁর কথাই শেষ কথা। রাজনীতি, রাষ্ট্রের নীতি, সংস্কৃতি-সাহিত্যের প্রতিটি দিক সম্পর্কে তিনি ফায়সালা দেন এবং তাঁর কথাকে তাঁর অনুসারীরা ‘ফাসল-ইল-খিতাব’ বা ‘আলোচনার উপসংহার’ বলে মানেন। তিনি ঘোষণা করতে পারতেন, তাঁর ছেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে না। কিন্তু তিনি এমন কোনো কিছু বলেননি। তার মানে, ছেলেকে স্থলাভিষিক্ত করার বিষয়ে তাঁর সায় থাকলেও থাকতে পারে।

সর্বোচ্চ নেতার ভূমিকায় খামেনির নিজের গদিনশিন হওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের ঐতিহ্য অনুসরণ করা হয়েছিল। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি বলেছিলেন, কেউ একজন আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে বলতে শুনেছেন যে খামেনি তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি।

রাফসানজানির ওই কথাকেই আয়াতুল্লাহ খোমেনির অসিয়ত হিসেবে ধরে নিয়ে খামেনিকে সর্বোচ্চ নেতৃত্বে বসানো হয়। এখন সমস্যা হলো, খামেনি এখনো তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কারও নাম বলেননি।

সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বৈধতার সংকট ইরানি সমাজের একটি বৃহৎ এবং ক্রমবর্ধমান অংশেও বিরাজ করছে। নারী, জীবন, স্বাধীনতা, প্রতিবাদ, আন্দোলন—এগুলো সাম্প্রতিকতম সময়ে ইরানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

অনেক ইরানি বিশ্বাস করেন, দেশটিতে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, নৈরাজ্যবাদী, অযোগ্য, অসামাজিক এবং স্বৈরাচারী শাসন রয়েছে। এখানে নেতা নির্বাচনে জনগণের মতের কোনো প্রতিফলন থাকে না।

খামেনি মারা গেলে আইআরজিসি হবে চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎস এবং মোজতবাই হবেন সম্ভবত তাদের পছন্দের সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু এই প্রজন্মের ইরানিদের কাছে তিনি কতটা গ্রহণযোগ্য হবেন, তা তর্কসাপেক্ষই রয়ে গেছে।

● আব্বাস মিলানি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইরানি স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক এবং হুভার ইনস্টিটিউশনের একজন রিসার্চ ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত