মতামত

আওয়ামী লীগের সাধারণ ক্ষমা এবং হেফাজতের ‘যৌক্তিক’ দাবি

হঠাৎ দুটি খবর চোখে পড়ল। দুটিই আওয়ামী লীগকে ঘিরে। একটি হলো সাধারণ ক্ষমা, অন্যটি হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। এক বছর পর জাতীয় সংসদের নির্বাচন। বোঝা যায়, এখন যেসব কথাবার্তা বা কাজকর্ম হবে, তা আগামী নির্বাচন ঘিরে।

সাধারণ ক্ষমার কথা উঠলেই ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কথা মনে পড়ে যায়। ওই সময় দেশে যুদ্ধ চলছে। তরুণেরা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি কলকাতা-আগরতলায় খুব কষ্টে আছেন। তাঁরা দেশে ফিরতে চান।

ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ঢাক বাজতেই তাঁদের অনেকের নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। তখন একদিকে ভারত সরকারের গোয়েন্দারা এবং অন্যদিকে মুজিব বাহিনীর ছেলেরা তাঁদের কড়া নজরদারিতে রেখে, হুমকি-ধমকি দিয়ে আটকে রেখেছিলেন।

আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক ‘সাধারণ ক্ষমার’ বিষয়টি নতুন নয়। আমরা জানি, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু হওয়ায় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দলের ওপরের স্তরের কোনো নেতার আশীর্বাদ পেয়ে অনেকেই প্রার্থী হচ্ছেন। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা। তাঁরা অনেকেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলেও কেউ কেউ থেকে যাচ্ছেন লড়াইয়ে। তাঁদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

তাঁদের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে পরিচিতি দাঁড়িয়ে গেছে। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। এতেও কাজ হচ্ছে না। অনেক ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ নির্বাচনে দলের ‘মনোনীত’ প্রার্থীকে হারিয়ে জিতে যাচ্ছেন। এর ফলে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হচ্ছে—জনপ্রিয় প্রার্থী সব সময় দলের মনোনয়ন পান না। মনোনয়নের পেছনে কাজ করে আশীর্বাদ, পৃষ্ঠপোষকতা ও লেনদেন। দল যাঁকে চায়, ভোটাররা তাঁকে চান না।

 শুরু থেকেই এ রকম হচ্ছে। এটি জাতীয় নির্বাচনেও দেখা গেছে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন ঢাকার লালবাগের হাজি সেলিম। তিনি একবার আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পান। নির্বাচনী প্রচারের সময় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেছিলেন, শেখ হাসিনা তঁাকে স্বতন্ত্র হিসেবে নমিনেশন দিয়েছেন। আমি নিজ কানে এটা শুনেছি। যাহোক, তিনি এখনো আছেন। তিনি দলের একজন বড় সম্পদ। এ রকম আরও আছেন।

হেফাজত আরও চায়। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলে আমরা একাত্তরে ফিরে যাই। আমরা কী চেয়েছিলাম? হেফাজতের দাবিদাওয়াকে ‘যৌক্তিক’ বিবেচনা করে পূরণে উদ্যোগ নেওয়া এত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তান ভাঙার কী দরকার ছিল? প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে কেউ তাঁর দর্শন ও কর্মসূচি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কিন্তু প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কোনোরকমের লেনদেন হলে ধরে নিতে হবে, এখানে অন্য রকম খেলা হবে। বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে—ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে যে কারও সঙ্গে আঁতাত করা যায়। 

ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে শুধু বিদ্রোহী প্রার্থীই দাঁড়ান না; সেখানে তুমুল যুদ্ধও হয়। মারামারি-খুনোখুনি হয়। তারপর বিদ্রোহী প্রার্থী জিতে এলে দল ও জাতির প্রতি ‘মূল্যবান অবদানের’ কথা স্মরণ করে তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়।

এ বছর স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা এবং একই সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিহত মানুষের সংখ্যা পূর্ববর্তী সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় নেতারা হচ্ছেন দলের খুঁটি। তাঁদের বাদ দিয়ে নির্বাচনের লড়াইয়ে জেতা কঠিন। অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাওয়ায় দলের অবস্থান অনেক জায়গায় নড়বড়ে হয়ে গেছে। সুতরাং ঘর শক্তপোক্ত করার তাগিদেই তাঁদের দলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হয়েছে। এ-ই হলো ‘সাধারণ ক্ষমার’ মাজেজা। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছে। আর দলের সভাপতি তো নানান সরকারি অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন।

একদিকে বিএনপি মাঠে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নিজেদের গোছাচ্ছে, এটিও একটি কৌশল। প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত রেখে এগিয়ে যাওয়া।

আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে যে ছক করছে, তাতে তার আরেকটি কৌশল হলো সম্ভাব্য ‘শত্রুদের’ নির্বিষ করে ‘মিত্র’ বানানো। আমরা জানি, আওয়ামী নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটে এমন কিছু দল আছে, যারা বরাবরই ছিল আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড বিরোধী। আওয়ামী লীগ তাদের পক্ষভুক্ত করেছে। নানা ‘ছাড়’ দিয়ে। আওয়ামী লীগের নৌকায় না চড়লে তাঁদের অনেকেই ইহকালেও সংসদ ভবনে ঢুকতে পারতেন না। আওয়ামী লীগের আরেকটি হিসাব ছিল—তারা যেন বিএনপির ডালে গিয়ে বাসা না বাঁধে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো। বিএনপি ‘কোণঠাসা’ হলো। আওয়ামী লীগ হলো নিশ্চিন্ত। না হয় গেলই দু-চারটা সংসদীয় আসন। এখন আওয়ামী পক্ষপুটে আশ্রয় নেওয়া ওই সব দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা—কে বিএনপিকে কত বেশি গোল দিতে পারে। এদের বলা হয় মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ।

দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একটা জোয়ার দেখা যাচ্ছে, প্রতিভূ ছিল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত এখন অনেকটা নির্জীব। কেউ মারা গেছেন, কেউ জেলে, অন্যরা পলাতক। তবে মাঠে আছে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের এক প্রবণতা। নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ শক্তি হিসেবে দাবি করলেও এরা যে দারুণ ক্ষমতাশীল একটি পক্ষ, এর প্রমাণ তারা দিয়েছিল ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে। আওয়ামী লীগ যেভাবে তার সম্ভাব্য শত্রুদের মিত্র বানিয়ে জোটে ঠাঁই দিয়েছিল, একই কৌশল তারা নিয়েছে হেফাজতের ক্ষেত্রে। লক্ষ্য একটাই, তারা যেন প্রতিপক্ষের শিবিরভুক্ত না হয় অথবা সরকারের বিরুদ্ধে চলে না যায়। হয় সঙ্গে থাকুক, তা না হলে ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে যাক।

হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমীকরণের ফলাফল দেখা গেছে রাজনীতি, সামাজিক কর্মকাণ্ড, এমনকি শিল্প-সংস্কৃতিতেও। টেক্সট বুক বোর্ডের অনেক বইয়ে পরিবর্তন এসেছে। হেফাজতের দাবিকে প্রশ্রয় দিয়ে বইয়ে বদল আনা হয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।

১৭ ডিসেম্বর হেফাজতের ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাত দফা দাবি জানিয়েছে। এর পরদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দাবিদাওয়াগুলোর মধ্যে যেগুলো যৌক্তিক, সেগুলো প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই দেখবেন। পূরণ করবেন’ (প্রথম আলো, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২)।

প্রশ্ন হলো হেফাজতের ‘যৌক্তিক’ দাবিগুলো কী? আমরা জানি, আওয়ামী লীগ যে চেতনার কথা বলে বেড়ায়, হেফাজতের অনেক দাবি তার সঙ্গে মেলে না। প্রধানমন্ত্রী আগে তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, দেশ চলবে মদিনা সনদের ভিত্তিতে। কিন্তু এ কথায় সব দাবি পূরণ হয় না।

হেফাজত আরও চায়। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলে আমরা একাত্তরে ফিরে যাই। আমরা কী চেয়েছিলাম? হেফাজতের দাবিদাওয়াকে ‘যৌক্তিক’ বিবেচনা করে পূরণে উদ্যোগ নেওয়া এত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তান ভাঙার কী দরকার ছিল? প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে কেউ তাঁর দর্শন ও কর্মসূচি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কিন্তু প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কোনোরকমের লেনদেন হলে ধরে নিতে হবে, এখানে অন্য রকম খেলা হবে। বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে—ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে যে কারও সঙ্গে আঁতাত করা যায়। 

নির্বাচন ও ভোটারের ওপর আস্থা না থাকলে নেপথ্যে অনেক কারসাজি হয়। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক যোগাযোগ সন্দেহ তৈরি করেনি। এ রকমই হওয়ার কথা। নির্বাচন সামনে রেখে নানান শর্তে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভারসাম্য তৈরি হবে কিংবা বদলে যাবে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক