পুতিন পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেন।
পুতিন পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেন।

ভোটে হারবেন না পুতিন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা দুর্বল হবে

গত ডিসেম্বরে ন্যূনতম যে সন্দেহ ছিল, তারও অবসান ঘটিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে রাশিয়ায় আগামী কয়েক দিন প্রসাধনিক রূপান্তর চলবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। ভবনগুলো নতুন করে রং করে ঝকঝকে, তকতকে করা হবে। অবসর ভাতাভোগীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহ দিতে বিনা মূল্যে খাবার বিতরণ করা হবে। ভোট গ্রহণের দিনে ছাত্রছাত্রী ও সরকারি চাকুরেরা সারি বেঁধে ভোটকেন্দ্রের দিকে ছুটবেন তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করতে।

ভূমিধস বিজয় শেষে পুতিন এমন ভান করবেন যেন তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। নির্বাচনে সম্ভবত ভোট পড়ার হার সব ইতিহাস ছাপিয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে নির্বাচনটি ভোট চুরির নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচনটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। পুতিন সেটা ভালো করেই জানেন। বিবেচনা করুন তো, কেন তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আলেক্সি নাভালনিকে প্রত্যন্ত আর্কটিক অঞ্চলের উপনিবেশে নির্বাসিত করে রেখেছেন।

কর্তৃত্ববাদী জামানার নির্বাচন নিছক নাটকের চেয়েও বেশি কিছু। নির্বাচন স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা হাতিয়ার। ভোট হচ্ছে গণনার বিষয়। কিন্তু একটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ভোট গণনা অনানুষ্ঠানিক বিষয়। সেই ভোটও গোনা হয় বন্ধ দরজার অন্তরালে।

কর্তৃত্ববাদী জামানার নির্বাচন নিছক নাটকের চেয়েও বেশি কিছু। নির্বাচন স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা হাতিয়ার। নির্বাচনটি যদি কার্যকরভাবে শেষ করা যায়, তাহলে এ ধরনের ভুয়া নির্বাচন শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বকে সংহত করে। আর নির্বাচনটা করতে যদি গুবলেট পাকিয়ে ফেলে, তাহলে পুরো শাসক চক্রকেই বিপদের মুখে পড়তে হয়।

ওপরের প্রলেপটা উঠিয়ে দিলে প্রত্যেক স্বৈরশাসকের চূড়ান্ত ক্ষমতার পেছনে যে সত্য লুকিয়ে থাকে, তা হলো কোনো শাসকই একা শাসন করতে পারে না। প্রত্যেক নেতা তাঁর ক্ষমতা ততক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি বিজয়ী জোটের এবং মূল নীতিনির্ধারকদের (যারা তার ক্ষমতা ধরে রাখা ও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম) সমর্থন ধরে রাখতে পারেন।

একটা গণতান্ত্রিক দেশে জোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন থাকে। কিন্তু পুতিনের ক্ষেত্রে তাঁর ইনার সার্কেল বা ঘনিষ্ঠজনেরা ক্ষমতার উৎস। অর্থাৎ যেসব বন্ধু ও ইয়ার দোস্ত পুতিনের ক্ষমতার উত্থানে সহায়তা করেছেন এবং প্রতিদানে তিনি যাঁদের সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও শিল্পকারখানার শীর্ষ পদে বসিয়েছেন, এ ব্যবস্থায় তাঁরাই সর্বেসর্বা।

ভোট হচ্ছে গণনার বিষয়। কিন্তু একটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ভোট গণনা অনানুষ্ঠানিক বিষয়। সেই ভোটও গোনা হয় বন্ধ দরজার অন্তরালে।

নির্বাচন সামনে রেখে স্বৈরশাসক ও তাঁর ইনার সার্কেলের লোকজন তাঁদের মধ্যে হওয়া চুক্তি নবায়ন করেন। এই চুক্তি নবায়নের জন্য ইনার সার্কেলের লোকদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধান করা হবে, সেই শক্তিসামর্থ্য দেখাতে হয় স্বৈরশাসককে। এর বিনিময়ে ইনার সার্কেল স্বৈরশাসকের প্রতি তাদের আনুগত্য অব্যাহত রাখে।

নিয়োগপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কর্মীরা গিয়ে ভোট দেন, অলিগার্কিরা ভোটের প্রচারণায় অর্থ দেন আর নিরাপত্তা সংস্থার লোকজন দাঁড়িয়ে যান ভিন্নমতের লোকদের ধরে ধরে শায়েস্তা করতে।

জনগণ মানে ভোটারদের কাছে নেতাদের প্রত্যাশা হলো তাঁরা যেন শাসকগোষ্ঠীর প্রতি রাবার-স্ট্যাম্প মার্কা সমর্থন অব্যাহত রাখেন। বিষয়টিকে খুব তুচ্ছ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একটা সরকারের স্থিতিশীলতার গতিমুখ কোন দিকে যাচ্ছে, তা নির্ধারণে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নিপীড়ন ও প্রপাগান্ডার মিশ্রণে চালু থাকা একটা সরকার কার্যকর আছে, নাকি নতুন সরকার দরকার, এর প্রতিফলন এতে হয়।

এই যে একেবারে নীলনকশার নির্বাচনী যে প্রক্রিয়া, তাতে বিস্ময়কর কিছু ঘটার সুযোগ একেবারেই কম। এরপরও নেতা ও সমর্থকদের জন্য নির্বাচনের আগে ও পরের সময়টাতে একধরনের নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

২০১১ সালে রাশিয়ায় যে ব্যাপক কারচুপির নির্বাচন হয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় বিক্ষোভ হয়েছিল। এর ফলে নাভালনি ও তাঁর শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছিল। যদিও সেই বিক্ষোভ একসময় দমন করা গিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে সব সময় করা সম্ভব, তা অবশ্য নয়।

২০০৫ সালে ইউক্রেনের ঘটনাই ধরা যাক। পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ সে সময় ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগে যে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছিল, তাতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে।

এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পুতিন তাঁর দমনযন্ত্র আরও শক্তিশালী করেছেন, যাতে করে রাশিয়ায় জনগণ যেন বিক্ষোভের কোনো সুযোগ না পান।

২৫ বছর ধরে স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে পুতিন ভালো করেই জানেন, নির্বাচনকে কী করে নিজের সুবিধায় ব্যবহার করতে হয়। বিরোধীদের ওপর হুমকি দিয়ে, তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে এবং দলে অন্তর্ভুক্ত করে প্রার্থীদের কাউকে কাউকে বসে যেতে আর কাউকে কাউকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি আবার পুনর্গঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুতিন যথেষ্ট শক্তিশালীই রয়েছেন। রক্ষণশীল মতাদর্শ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি নস্টালজিয়ার কারণে পুতিন ও তাঁর অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে কারও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ঘুম কামাই হচ্ছে, এমনটা নয়। এরপরও পুতিন পুরোপুরি নিরাপদ নন।

ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে পুতিন এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে চান এবং নির্বাচনের আগে যেকোনো মূল্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চান।

কিন্তু পুতিন চাইলেই কি বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পারবেন? ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের মুখে পড়া, মূল্যস্ফীতি অথবা দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারি রুশ অভিজাতদের মধ্যে রুশদের অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে।

  • ওলগা চাইজ রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ে গবেষক। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত