হোয়াইট হাউসে ভলোদিমির জেলেনস্কি ও জো বাইডেন
হোয়াইট হাউসে ভলোদিমির জেলেনস্কি ও  জো বাইডেন

ইউক্রেনে অভ্যুত্থান ঘটানো ছাড়া আমেরিকার সামনে পথ নেই

বাইডেন প্রশাসনে এ বিষয়ে ঐকমত্য বাড়ছে যে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ ঝুলে গেছে। এ ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় আসা প্রয়োজন।

বিষয়টিকে এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘দীর্ঘদিনের প্রস্তাবিত’ নীতি হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। কিন্তু সত্য এর পুরো উল্টোটা। বাইডেন প্রশাসনই রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো ধরনের শান্তিচুক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি করেছে।

বাইডেন ও তাঁর সঙ্গীরা জেলেনস্কিকে একই কারণে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন।

জেলেনস্কি এক বছরের বেশি সময় আগে পার্লামেন্টে এই আইন পাস করেন যে যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা তাঁর জন্য আইনসম্মত হবে না। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা দলেরও একই মতামত।

যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর দেশগুলো ইউক্রেনকে প্রচুর পরিমাণে সমরাস্ত্র, সাঁজোয়া যান ও গোলাবারুদ দিয়ে আসছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য জোগানোর পাশাপাশি সেনাদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তারা। যুদ্ধক্ষেত্রে উপদেষ্টাও পাঠিয়েছে। তাদের কয়েকজন এর মধ্যে হতাহতও হয়েছেন। যদি খবর সত্যি হয়, তাহলে ২৭ ডিসেম্বর রুশ বাহিনী ইউক্রেনের খেরসনে একটি ট্রেন ডিপোতে  রকেট হামলা করলে ইউক্রেনের ৬০ জন সেনা ও পুলিশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের চারজন পরিচালক নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী পরাজয়ের মুখে পড়তে চলেছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সবখানেই ইউক্রেনীয় বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। রুশ বাহিনী দনবাস অঞ্চলে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম মারিনকা থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। জাপোরোঝঝিয়া অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বাখমুত ও আভদিভকা অঞ্চলের গ্রামগুলো থেকেও ইউক্রেনীয় বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে রুশ বাহিনী।

ভগ্নস্বাস্থ্য ও অসুস্থতা—এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর অর্থ হচ্ছে, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী—যে কাউকে ধরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে। এ ঘটনা অনিবার্যভাবেই জেলেনস্কির প্রতি মানুষের সমর্থন একেবারে তলানিতে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে কিয়েভ, ওদেসা ও খারকিভের মতো বড় শহরগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ঘটবে।

ইউক্রেনীয় বাহিনীর কমান্ডার ভ্যালেরি জালুঝনি মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আভদিভকা শহরের পতন হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনীয় বাহিনী সেখান থেকে খুব দ্রুত নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে কিংবা আত্মহননের মতো করে হামলা করে আভদিবকা শহর দখলে নেওয়ার চেষ্টা করবে বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে ইউক্রেনের রাজনীতিতে ফাটল ক্রমেই বাড়ছে। দুইবার ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন ইউলিয়া তিমোশেঙ্কো। বর্তমান সংসদে তিনি পিতৃভূমি দলের সংসদ সদস্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ন্যাটোর সদস্য হোক ইউক্রেন, এ ধারণার একজন জোরালো সমর্থক তিনি। সেই তিমোশেঙ্কো বলেছেন, তাঁর দেশ একেবারে মুমূর্ষু দশায় এবং পরাজয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

পুতিনকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ের তথ্য দিচ্ছেন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু

ইউক্রেনের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁদের হয় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোকে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা। আর জেলেনস্কিকে যাঁরা অতিক্রম করতে চাইছেন, তাঁদের ভাগ্যে আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের রাজনীতিবিদ আলেকসান্দ্রার দুবিনিস্কির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগ শুধু তাঁর একার বিরুদ্ধে আনা হয়নি।

যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনা বেড়ে চলায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপক জনবলসংকটে পড়েছে। সেনাবাহিনীতে ৫ লাখ নতুন লোকবল নিয়োগের আদেশ কে দিয়েছেন, তা নিয়ে গত সপ্তাহে জালুঝনি ও জেলেনস্কির মধ্যে কথার যুদ্ধ হয়ে গেল। সেনাপ্রধান বলেছেন, তিনি কখনোই ৫ লাখ সেনা নিয়োগের প্রস্তাব দেননি। আর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সেনাবাহিনী তাঁকে অতিরিক্ত ৫ লাখ লোক নিয়োগের কথা বলেছে।

প্রকৃতপক্ষে এখানে সংখ্যা কত, বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। এখানে মূল বিষয়টি হলো, সেনা নিয়োগের জন্য ইউক্রেন যে জবরদস্তিমূলক কৌশল বেছে নিয়েছে। রাস্তা কিংবা বাসাবাড়ি, গাড়ি কিংবা ক্লাব, পালানোর সময় সীমান্ত থেকে ধরে কিংবা অন্য যেকোনো জায়গায় পাওয়া যাক না কেন, সেনাবাহিনীতে এভাবেই লোক নিয়োগ করা হচ্ছে।

সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য বছর বয়স ঠিক করা হয়েছে ১৮-৬০ বছর। কিন্তু বড়দিনের ভোজসভায় আসা সেনাদের যে ছবি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা মূলত মধ্যবয়সী ও বয়স্ক; তরুণদের সংখ্যা হাতেগোনা।

জালুঝনি এ বিষয়ের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, বয়স্ক সেনারা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারেন না। কেননা, তরুণ সেনাদের তুলনায় তাঁদের শারীরিক শক্তি অনেক কম। আরও খারাপ বিষয় হচ্ছে, অনেকে এখন আর সেনাবাহিনীতে কাজ করতে চাইছেন না।

সেনাবাহিনীতে জোর করে নিয়োগের এই ঘটনায় ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর (এ কারণেই জেলেনস্কি জালুঝনিকে দোষারোপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন) নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব ফেলছে। এ ঘটনার প্রভাব ইউক্রেনের বাইরেও পড়ছে।

কেননা, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগের জন্য যে বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে বয়সী ইউক্রেনীয়দের অনেকে এখন ইউরোপের অনেক দেশে বাস করছেন। ইউক্রেন চাইছে জোর করে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে।

এস্তোনিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এস্তোনিয়া ১৮-৬০ বছর বয়সীদের ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করতে পারে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।

ইউক্রেন সরকার বলছে, এ বয়সীদের কেউ যদি সেনাবাহিনীতে না আসেন, তাহলে তাঁকে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে এবং তাঁদেরকে সর্বোচ্চ আট বছর জেল খাটতে হবে।

ভগ্নস্বাস্থ্য ও অসুস্থতা—এ ধরনের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এর অর্থ হচ্ছে, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী—যে কাউকে ধরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে। এ ঘটনা অনিবার্যভাবেই জেলেনস্কির প্রতি মানুষের সমর্থন একেবারে তলানিতে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে কিয়েভ, ওদেসা ও খারকিভের মতো বড় শহরগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ঘটবে।

নতুন এই নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করে সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। কিন্তু তত দিনে ইউক্রেনীয় বাহিনীর রুশ বাহিনীর কাছে আরও অনেক পরিমাণ ভূমি হারিয়ে ফেলবে।

যুদ্ধের এই অবস্থায় এসে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ছাড়া রাশিয়া কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে যাবে না। কেননা, তাতে পুতিনের গ্রহণযোগ্যতায় ধস নামবে। অন্যদিকে জেলেনস্কিও রাশিয়ার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যেতে রাজি নয়।

ওয়াশিংটন যদি সত্যি সত্যি কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়, জেলেনস্কিকে দিয়ে সেটা করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের হাতে একটাই বিকল্প থাকবে। সেটা হলো ইউক্রেনে অভ্যুত্থান ঘটানো এবং জেলেনস্কির পরিবর্তে এমন কাউকে আনা, যিনি কিনা রাশিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় যেতে আগ্রহী।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত