আমরা চাই একটি আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়া বাংলাদেশে অতীতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করুক।
আমরা চাই একটি আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়া বাংলাদেশে অতীতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করুক।

অন্তর্বর্তী সরকারের কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়া উচিত

অন্তর্বর্তী সরকার একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তাদের অভিনন্দন জানাই। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম ফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স) স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই অর্জনের জন্যও অন্তর্বর্তী সরকার অভিনন্দন পেতে পারে।

এ লেখাটি আমরা লিখছি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে। বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বছরের পর বছর ধরে আমরা কাজ করেছি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই আমরা। শুধু একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আমাদের আকাঙ্ক্ষা।

আমরা চাই একটি আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়া বাংলাদেশে অতীতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করুক। এ ধরনের প্রক্রিয়াকে দেশের স্থায়ী গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করি আমরা। অধিকার লঙ্ঘনের শিকার যাঁরা আর তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এভাবে সবচেয়ে কার্যকর ন্যায়বিচার পেতে পারেন।

অপরাধের ধরন

আমাদের মতে, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পূর্ববর্তী সরকারের দ্বারা সংঘটিত গুরুতর অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিচারিক সংস্থা।

পূর্ববর্তী সরকার যেসব অপরাধ করেছে সেগুলো মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এ দুটোই আইসিসির কাছে উল্লেখ করা যেতে পারে:

ক. সাম্প্রতিক ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় হত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন; এবং

খ. গত এক দশকে জোরপূর্বক গুম এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। পূর্ববর্তী সরকার এ ধরনের আটককে অস্বীকার করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ত্যাগের পরে কিছু বন্দী মুক্তি পেয়েছেন।

ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ শুরুর আগে এবং এই বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশে ঘটেছে, এমন সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ আমরা লক্ষ করেছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভের আগে এ ধরনের অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধগুলোর মধ্যে আছে বলপূর্বক গুম, সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড, নির্যাতন ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন। এর ফলে অনেক বাংলাদেশি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের গণহত্যার জোরালো প্রমাণ রয়েছে। এই হত্যার নির্দেশ পূর্ববর্তী সরকারের একেবারে উঁচু মহল থেকে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয়।

প্রতিশোধ এবং দায়মুক্তির চক্র

বাংলাদেশে সহিংসতা, প্রতিশোধ এবং দায়মুক্তির এক চক্র লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক অতীতে দেশের যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা এই চক্রকে অটুট রেখেছে। বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার কোনো দলের নয়। এই চক্রটি ভাঙার সুযোগ এবং ক্ষমতা তাদের রয়েছে। আমরা আশা করি, তারা এ সুযোগটি গ্রহণ করবে।

পূর্ববর্তী সরকারের সময় সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কাছে পাঠানো উচিত বলে আমরা মনে করি। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্র বিক্ষোভের আগে এবং বিক্ষোভ চলাকালে সংঘটিত অপরাধগুলো। আর এ কাজটি করা উচিত অন্তর্বর্তী সরকারের। এর জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে আইসিসির প্রসিকিউটর দপ্তর। তারাই এ ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর আন্তর্জাতিক সংস্থা।

আইসিসি দায়িত্ব নিলে কী সুবিধা

অন্তর্বর্তী সরকার নিজে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রাষ্ট্রীয় রেফারেল (আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু পাঠানো) দিয়ে উল্লিখিত অপরাধের বিচার চাওয়ার আলাদা গুরুত্ব আছে। তাহলে আইসিসির প্রসিকিউটর সেই আদালতের প্রাক্-বিচার চেম্বার থেকে অনুমতি না নিয়েই তদন্ত শুরু করতে পারবেন। আইসিসির কাছে যাওয়ার বদলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাও করা যায়। তবে এর চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রেফারেল ভালো বলে বিবেচনা করার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কারণ লক্ষণীয়:

ক. আইসিসি-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা: আইসিসির প্রকৃতি আন্তর্জাতিক। অপরাধের তদন্ত, বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এর কোনো সংযোগ নেই বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। ফলে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট বলে সমালোচনা করা যাবে না।

আইসিসি দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোয় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। দেশের বিচারব্যবস্থায় বিভিন্ন পক্ষ সরাসরি যুক্ত। ফলে দেশের বিচারব্যবস্থায় প্রক্রিয়া শুরু হলে সমাজের মধ্যে উত্তেজনা এবং অবিশ্বাস তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অস্থিতিশীলতা বেড়ে যাওয়ার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক ধারণা আছে। একে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অধিকার লঙ্ঘনকারী সংস্থা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এর পেছনে দায়ী সংস্থাটির আগের কার্যকলাপ। এমন গুরুতর অপরাধীদের বিচারের জন্য এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হলে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। ট্রাইব্যুনালকে দায়িত্ব দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায়ের সমর্থন হ্রাস পেতে পারে।

বাংলাদেশের আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। পাশাপাশি যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় বিচার করতে গেলে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সব মিলিয়ে অভিযুক্তদের যাঁরা বাংলাদেশের বাইরে আছেন তাঁদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি হবে। ন্যায্য বিচারের অধিকার সুরক্ষিত হবে, এমন নিশ্চয়তা না থাকার ভিত্তিতে সন্দেহভাজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশের আদালত বাধা দিতে পারেন। আর অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের বিচার করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা হবে না। এ ছাড়া আইসিসির ১২৪টি সদস্যরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। এই রাষ্ট্রগুলোর আইসিসির ওয়ারেন্ট পাওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। সেই সঙ্গে আইসিসিভুক্ত নয়, এমন রাষ্ট্রগুলোও বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে আপত্তি তুলবে না।

খ. আইসিসির কাছে রেফারেল দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের পরে আসা বাংলাদেশ সরকারের সম্ভাব্য দায়মুক্তি থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে: অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় বিচার শুরু করলে ভবিষ্যতের কোনো সরকার তা বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের রেফারেলের ভিত্তিতে আইসিসি প্রসিকিউটর তদন্ত শুরু করলে ভবিষ্যতের কোনো সরকারের তাতে বাধা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

আইসিসির কাছে রেফারেল বাংলাদেশে দায়মুক্তির ধারাবাহিকতা রোধ করতে সাহায্য করবে। এর ফলে যেকোনো বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ আচরণও প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

গ. আইসিসির কাছে রেফারেল বাংলাদেশের সম্পদও বাঁচাবে: বাংলাদেশ বর্তমানে একটি কঠিন পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিবেশকে শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় রেফারেল দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পদ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পুরোপুরি ব্যয় করা যাবে।

ঘ. আইসিসি রেফারেল থাকলে আইসিসি প্রসিকিউটর দপ্তর থেকে জোগাড় করা প্রমাণ ভবিষ্যতে বিচারের জন্য বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যাবে: আমরা আশা করি, আইসিসি প্রসিকিউটর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়ার অনুরোধ করবেন। তাহলে পূর্ববর্তী সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিচারের জন্য বস্তুনিষ্ঠভাবে সংগৃহীত প্রমাণ সংগ্রহ করা হবে। সেসব প্রমাণ অপরাধগুলোর পরবর্তী স্তরের বিচার করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিচারপ্রক্রিয়া স্থানীয়ভাবে হতে পারে। হতে পারে দেশব্যাপী অন্য কোনো প্রক্রিয়া, যেমন সবচেয়ে দায়ী ব্যক্তিদের আইসিসির দায়িত্বে বিচার বা সত্য এবং জবাবদিহি প্রক্রিয়া। এই রেফারেল দেশকে আরও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করবে।

আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে আইসিসির কাছে একটি রেফারেল দেওয়ার আহ্বান জানাই। এর ফলে বিশ্বের কাছে একটি বার্তা দেওয়া হবে, বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের জন্য কোনো দায়মুক্তি থাকবে না। আর বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে নিপীড়নের অন্তহীন চক্র ভেঙে দেওয়া জরুরিও বটে।

  • মাইকেল পলাক আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে ব্যারিস্টার। আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার-সম্পর্কিত সালিস ইত্যাদি নিয়ে কাজের জন্য পরিচিত।

  • আব্বাস ফয়েজ দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ; বাংলাদেশবিষয়ক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষক; এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন