‘আমি চাই না আমার ছেলের মৃত্যুর আগের ভিডিও অন্য কোনো মা-বাবা দেখুক’—বলছিলেন মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়ে আত্মহত্যা করা ইরফান সাদিকের মা শান্তা ইসলাম। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি দেখে অনুমান করা যায় ইরফান সাদিক পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আসলেই কি ইরফান সাদিক আত্মহত্যা করেছেন? নাকি বুলিং কিংবা র্যাগিংকারীরা তাঁকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন?
ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বুলিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন মর্মে তাঁর মা-বাবা আদালতে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেছেন।
ইরফানের মৃত্যুর দায় হয়তো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিতে হবে না। আর অরিত্রী অধিকারীকে আমরা আর এই পৃথিবীতে পাব না। অরিত্রী অধিকারীর ভাগ্য যেন কাউকে আর বরণ করতে না হয়, সে বিষয়ে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে আজ আলোচনা করব।
বুলিং বলতে সাধারণত বুঝি একটি সামাজিক অপরাধ, যেখানে একজন মানুষ কর্তৃক অন্য একজন মানুষকে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অপর দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং বলতে বোঝানো হয় নতুন শিক্ষার্থীদের ওপর ইতিমধ্যে বিদ্যমান শিক্ষার্থী কর্তৃক মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধসংক্রান্ত নীতিমালা–২০২৩ অনুযায়ী, বুলিং ও র্যাগিংকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো মৌখিক বুলিং ও র্যাগিং; শারীরিক বুলিং ও র্যাগিং; সামাজিক বুলিং ও র্যাগিং; সাইবার বুলিং ও র্যাগিং এবং যৌনতাপূর্ণ বুলিং ও র্যাগিং। ২০২৩ সালের ২ মে প্রকাশিত এ নীতিমালায় বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ৩-৫ সদস্যবিশিষ্ট বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে।
বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার শিশুদের মানসিক চাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা আত্মহত্যা করতে পারে। যা ঘটেছে ইরফান সাদিক এবং অরিত্রী অধিকারীর ক্ষেত্রে। একজন নিষ্পাপ শিশুর আত্মহত্যা করা অনেক বড় ঘটনা বলে তা আমাদের নজরে এসেছে। বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার অসংখ্য শিশুর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
দেখার বিষয়, চার মাস অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে কি না? এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা কার্যকরে তদারকি আরও জোরদার করতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে বুলিং ও র্যাগিংয়ের উদাহরণ এবং পরিণতি সম্পর্কে পোস্টার লাগানো হয়েছে কি না, কিংবা সব শিক্ষার্থী কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বুলিং ও র্যাগিং করবেন না, কাউকে বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার হতে দেখলে রিপোর্ট করবেন, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন মর্মে শপথ পালনের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করানোর যে নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো কার্যকর হয়েছে কি না, তা–ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে।
বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার শিশুদের মানসিক চাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা আত্মহত্যা করতে পারে। যা ঘটেছে ইরফান সাদিক এবং অরিত্রী অধিকারীর ক্ষেত্রে। একজন নিষ্পাপ শিশুর আত্মহত্যা করা অনেক বড় ঘটনা বলে তা আমাদের নজরে এসেছে। বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার অসংখ্য শিশুর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার শিশুরা অনেক বেশি নিজেকে গুটিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে সামাজিক পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যারা বুলিং ও র্যাগিংয়ে জড়িত, কিংবা যারা বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার, তারা কেউই এ বিষয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত নয়। অথচ ভবিষ্যৎ জীবনে বুলিং ও র্যাগিংয়ের বীজ এ স্তর থেকেই শুরু হয়। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকেরা এবং অভিভাবকদের বুলিং ও র্যাগিংয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে পারলেই এই সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের দেশ মুক্ত হতে পারবে, এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না।
প্রাথমিক স্তরের বুলিংয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে বিকৃত নাম কিংবা শিক্ষার্থীদের কোনো ডাক নাম দেওয়া। যেমন যে শিক্ষার্থীর কিছুটা স্থূলতা রয়েছে তাকে জাম্বুরা, গোল আলু, কুমড়া প্রভৃতি নামকরণ। একইভাবে চিকনদের বোতল, ঢ্যাঁড়স; তুলনামূলক লম্বাকে তালগাছ প্রভৃতি নামে ডাকা। এ ধরনের নাম দেওয়াও যে একধরনের বুলিং, তা কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জানে না। অথচ বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা সারা জীবন মনে করে, তারা শারীরিকভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা। এ ধরনের নেতিবাচক চিন্তা তাদের সারা জীবন বয়ে নিয়ে চলতে হয়। এমনকি শারীরিকভাবে তুলনামূলক মোটা হওয়ার কারণে বুলিংয়ের শিকার হয়ে আমাদের দেশে মৃত্যুর অভিযোগ পর্যন্ত এসেছে [সামিনের মৃত্যু ও ‘স্কুল বুলিং’, শিল্পী রহমান, সমকাল, ১২ জুলাই ২০২১, প্রিন্ট সংস্করণ ]।
তাই বিকৃত নামে ডাকা, শিক্ষার্থীর ধর্ম বা জেন্ডারের কারণে তাকে আলাদা বেঞ্চে বসতে দেওয়ার মতো ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধসংক্রান্ত নীতিমালা–২০২৩–এ বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের করণীয় প্রসঙ্গে ১২টি দিকনির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এই দিকনির্দেশনাগুলো কার্যকর করাসহ বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে আমরা সবাই যদি সচেতন হই, তাহলেই বুলিং ও র্যাগিংয়ের সামাজিক ব্যাধি থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারব বলে আশা করা যায়।
আফরোজা ইসলাম ইনস্ট্রাক্টর (সাধারণ), প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মানিকগঞ্জ।
এস এম শাহ্ জামান জুরিস কনসাল্ট, ইক্ষান ল’ অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড কনসালটেন্সি ফার্ম