মতামত

নির্বাচনের পরের রাজনীতি কী

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে যে আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়েছে, সাংবিধানিক ও আইনি ভাষায় একে ‘নির্বাচন’ বলে বর্ণনা করা হলেও, চলমান ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় নিলে একে নির্বাচন বলে অভিহিত করা কঠিন। যে কারণে সবার মনেই প্রশ্ন, এই নির্বাচনে সরকারে লক্ষ্য কী? এরপরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী হবে?

যেকোনো নির্বাচনের সময় একধরনের অনিশ্চয়তা থাকে, জনগণের মনে প্রশ্ন থাকে—কোন দল কাকে প্রার্থী করছে, কে জিতবেন, দলগুলো কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কে বিজয়ী হবেন?

এসব প্রশ্নের কারণে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৯৯১ সালের পর জনমত জরিপের একটি ধারা গড়ে উঠেছিল। একাধিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের উদ্যোগে পরিচালিত এসব জরিপের দিকেও অনেকে চোখ রাখতেন। সেই ধারা ২০১৮ সালের আগেই হারিয়ে গেছে।

যাঁরা তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র বিষয়ে গবেষণা করেন, যাঁরা গণতন্ত্রের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করতে চান, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য আছে। কিন্তু অন্তত এ বিষয়ে ঐকমত্য আছে যে গণতন্ত্র হচ্ছে এমন ধরনের সরকার বা রেজিম, যেখানে সরকারের পদগুলো ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূরণ করা হয়।’

হোসে অ্যান্টোনিও চিউবাব, জেনিফার গান্ধী ও রেইমন্ড ভ্রিল্যান্ড ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এই ঐকমত্যের সারাংশ তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘সরকারি পদ’ বলতে প্রধান নির্বাহী এবং আইনসভাকে বুঝতে হবে এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ হচ্ছে এমন একধরনের অবস্থা, যেখানে সরকারের একটি বিরোধী পক্ষ আছে এবং নির্বাচনে যাঁদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে (‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডিক্টেটরশিপ রিভিজিটেড,’ পাবলিক চয়েস, ১৪৩ (২))।

প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাডাম প্রেজেওয়ারস্কি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে গণতন্ত্রে নির্বাচনের তিনটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন; ১. অনিশ্চয়তা, অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল নির্বাচনের আগে জানা যায় না। ২. অপরিবর্তনীয়, অর্থাৎ নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ফলাফল বদলানো যায় না; বিজয়ী প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব গ্রহণ করে। ৩. পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা, অর্থাৎ প্রথম দুটি মানদণ্ড পূরণ করে, এমন নির্বাচনগুলো নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে ঘটে। পরের দুটি বৈশিষ্ট্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, যদি প্রথমটি অনুপস্থিত থাকে।

আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে কার্যত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে অপসারণ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটা করতে রাজনীতি নয়, ব্যবহার করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যবহার নতুন কিছু নয়।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সারা দেশে কী ঘটেছে, তা বিস্মৃত হওয়ার কারণ নেই। গায়েবি মামলা, নির্বিচারভাবে সাধারণ নাগরিকদের হেনস্তা, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের ঘটনা ঘটিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে একবার একদলীয় এবং একবার বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনার আগে গত ২৮ অক্টোবর শক্তি প্রয়োগ করে বিএনপির সমাবেশ পণ্ড করে দিয়ে দলটির বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ভায়োলেন্ট ক্র্যাক ডাউন’ বলে বর্ণনা করেছে।

দল এবং দলছুট কয়েকজনের অংশগ্রহণকে দেখিয়ে যা সাজানো হচ্ছে, তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো দূরের কথা, নির্বাচন বলা যায় কি না, সেটাই প্রশ্ন। আর যেভাবে এই নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে, তাতে নির্বাচনের পর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী হতে পারে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীনেরা কেবল যে নির্বাচন সাজাচ্ছেন তা নয়, তাঁরা আসলে সাজাচ্ছেন আগামী দিনের রাজনীতি। তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশে অনেক দল আছে, সেটা দেখানো, কিন্তু কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটানো।

শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ হাজার হাজার কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তা ছাড়া গত সাড়ে তিন মাসে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরোনো মামলাগুলো অকস্মাৎ অভাবনীয় দ্রুতগতি লাভ করেছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত এসব মামলায় দণ্ড দেওয়া হয়েছে ৮১৫ জনকে (ডিডব্লিউ, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩)।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের এই আচরণ, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যবহার এবং এই লক্ষ্যে আদালত রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন এই ধারণা তৈরি হওয়া পরিবেশে যা হচ্ছে, তাকে নির্বাচন বিবেচনা করার কারণ থাকে না।

এই পরিস্থিতি তৈরি করার পাশাপাশি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আনুকূল্যে তিনটি কথিত কিংস পার্টি তৈরি হয়েছে এবং অন্যদের টপকে তাদের নিবন্ধনও দেওয়া হয়েছিল এই লক্ষ্যে, যেন তারা বিএনপি ভেঙে প্রার্থী সংগ্রহ করতে পারে।

নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে দেখানোর জন্যই এমনটি করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, এই কাজে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। অকস্মাৎ অবস্থান বদলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দল এবং ব্যক্তিরা প্রলোভনে কিংবা চাপে পড়েই নির্বাচনের ট্রেনে উঠেছেন, অন্যরা বিভিন্ন সময় ‘চাপের’ কথা বলেছেন। এসব দল ও ব্যক্তি নির্বাচিত হতে চান প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই।

নির্বাচন বলতে যে অনিশ্চয়তা, তার কথা নাহয় বাদ দিলাম, আওয়ামী লীগের শরিকেরা ভোটারদের কাছে নয়, ক্ষমতাসীন দলের কাছে জয়ের নিশ্চয়তা চাইছে।

ভাগাভাগির বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে একসময় ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশ জাসদের নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেছেন ‘নির্বাচনে এক পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির কাজ চলছে’ (প্রথম আলো, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩)। নিশ্চয়তা চাওয়ার জন্য তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরণাপন্ন হয়েছে, কেননা বাস্তবতা তারা জানে। ক্ষমতাসীন দল না চাইলে তারা জিতবে না।

কেবল শরিকেরাই আসনের ভাগ চাইছে, তা কিন্তু নয়। এমন খবর ছাপা হয়েছে যে ‘আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীরাই চায় আসন-সমঝোতা’ (প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩)। এ খবর প্রকাশের পর কথিত প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রতিবাদ করেছে, এমন কথা শোনা যায়নি। ‘সরকারের সঙ্গে আন্দোলনে না পেরে’ নির্বাচনে গেছেন সেই দলের নেতার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়া কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা বোঝা দুরূহ নয়।

জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে অনেক দিন। দলের ভেতরে সংকট হলেও ওই দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণাপন্ন হন।

গত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাপার মধ্যে সমঝোতা করেই নির্বাচন হয়েছে। ২০০৮ সালে ৪৯টি আসনে প্রার্থী ছিল জাপার। জিতেছে সেই ২৯ আসনে, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি।

২০১৪ সালে সেই ৩৩ আসনে জিতেছে জাপা, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। নৌকার বিপরীতে জাপার জয় হয়েছিলে একটিতে। ২০১৮ সালে তাদের আসন কমে দাঁড়িয়েছিল ২২টিতে।

ফলে জাপার ভাগ্য যে আওয়ামী লীগই নির্ধারণ করে, তা জেনেই তারা এখন শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।

ফলে কিছু দল এবং দলছুট কয়েকজনের অংশগ্রহণকে দেখিয়ে যা সাজানো হচ্ছে, তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো দূরের কথা, নির্বাচন বলা যায় কি না, সেটাই প্রশ্ন। আর যেভাবে এই নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে, তাতে নির্বাচনের পর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী হতে পারে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ক্ষমতাসীনেরা কেবল যে নির্বাচন সাজাচ্ছেন তা নয়, তাঁরা আসলে সাজাচ্ছেন আগামী দিনের রাজনীতি। তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশে অনেক দল আছে, সেটা দেখানো, কিন্তু কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটানো।

এ ধরনের ব্যবস্থা কী ধরনের হতে পারে, তার একটি উদাহরণ হচ্ছে চীন। অনেকেই জানেন না যে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, চীনে ‘ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আরও আটটি গণতান্ত্রিক দল আছে’।

সরকারি ভাষ্য হচ্ছে , ‘এসব গণতান্ত্রিক দল গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন সহযোগিতা করা আর মিলিতভাবে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সমর্থন করার অধিষ্ঠান বেছে নিয়েছে।’

কম্বোডিয়ার দলব্যবস্থা প্রায় একই রকম। ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়া পিপলস পার্টির বাইরে যে ১৭টি দল আছে, তাদের লক্ষ্য ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করা নয়, ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা করা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না, সেটা শুধু তাদের এবং এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর নির্ভর করছে না। যারা নির্বাচন বর্জন করেছে, তারা সম্ভাব্য এই পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছে কি না এবং সেই পথযাত্রাকে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে কি না, তার ওপরও নির্ভর করছে।

বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নাগরিকদের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে, কিন্তু সরকার তা বিবেচনায় না নিয়ে নিজেদের মতো করে একটি নির্বাচন করার পথে এগোচ্ছে।

ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা শুধু এই একটি ‘নির্বাচন’–এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে না। ফলে বহুধাবিভক্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা দরকার যে এই নির্বাচনের সঙ্গে দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা এবং তাদের অস্তিত্বও জড়িত।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট