বিএনপিকে ঠেকাতে জনগণকে কষ্ট দেওয়া কেন

বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন থেকে ‘পরিবহন ধর্মঘট’ ডেকে খুলনাকে অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এতে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন।

পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনগণের ভোটাধিকার। আইয়ুব খান প্রথমে সেনাশাসন জারি করে জনগণের সব অধিকার কেড়ে নেন। এরপর তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের নামে দেশে এক আজব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ছিল না। বিডি মেম্বাররা প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। এরপর মানুষ আন্দোলন করে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানি শাসকচক্র সেই ভোটের রায় বানচাল করায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই ভেঙে যায়। বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি।

কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও ভোটাধিকার নিয়ে আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। খুলনায় বিএনপি আজ (২২ অক্টোবর) যে গণসমাবেশ ডেকেছে, তারও লক্ষ্য ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা। এর আগে বিএনপির আমলে, এরশাদের আমলে যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তারও উদ্দেশ্য ছিল ভোটাধিকার। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ অন্যদের নিয়ে আন্দোলন করেছে। এখন বিএনপি ও অন্যান্য দল একই দাবিতে আন্দোলন করছে। এর শেষ কোথায়?

আজ খুলনা মহানগরীর সোনালী ব্যাংক চত্বরে বিভাগীয় গণসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। সরকার অনুমতিও দেয়। স্বাভাবিকভাবে মানুষ আশা করেছিল, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশটি হয়ে যাবে। সমাবেশের আগে ও পরে সেখানকার জনজীবন স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু বিএনপি খুলনায় সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুলনার পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা দুই দিনের ধর্মঘট ডেকে বসলেন। খুলনা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও মহাসড়কে নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা, অতুল, ইজিবাইকসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচলের প্রতিবাদে মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দুদিন পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে প্রয়োজনে সময় আরও বাড়তে পারে।

এই লেখা যখন শেষ করে আসছি, তখনই খবর পেলাম, খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও সব গণপরিবহন প্রায় বন্ধ। খুলনাগামী সব বাস যশোরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বাসের যাত্রীরা তো সবাই বিএনপির সমাবেশ যাবেন না। কেউ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাবেন,কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে যাবেন, কেউ কর্মস্থলে যাবেন, তঁাদের কেন আটকানো হলো? আর সরকার যখন সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, তখন দেশের যেকোনো স্থান থেকে লোক আসতে পারে।

কেবল সড়কপথ নয়, নৌপথও বন্ধ হয়ে গেছে শুক্রবার ভোর থেকে। বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেনের দাবি, লঞ্চশ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর খুলনা থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে না।

খুলনার বাস ও লঞ্চের মালিক-শ্রমিকদের নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা এত দিন মনে ছিল না। বিএনপি সমাবেশ ডাকার পরই তাঁদের হুঁশ হয়েছে। এর আগে ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে একই ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, খুলনার যে পরিবহনমালিকেরা দুই দিনের ধর্মঘট ডেকেছেন, তাঁরা আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগেরও নেতা। একই ব্যক্তির দ্বৈত রূপ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাসমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে সরকারের বা আওয়ামী লীগের কী করার আছে। সত্যিই কি তাঁদের কিছু করণীয় নেই? মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুরো খুলনা অঞ্চলে ট্রেন ছাড়া সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হলো, অথচ তিনি বলছেন কিছু করণীয় নেই। মানুষকে অতটা বোকা ভাবা বোধ হয় ঠিক নয়। সরকার নিজে যানবাহন বন্ধ না করে মালিক-শ্রমিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাজটি করেছে। সব সরকারই করে থাকে। বিএনপির আমলে যতবার সমাবেশ ডাকা হতো, ঢাকার চারপাশে অঘোষিত কারফিউ জারি হয়ে যেত। মনে আছে, ১৪ দল আহূত এক অবরোধের সময় তারেক রহমান ভাইকে নিয়ে রাস্তায় ক্রিকেটও খেলেছিলেন। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা তো খেলা।’

আসলে বাংলাদেশে রাজনীতিকেরা রাজনীতিকে খেলা হিসেবেই দেখেন। অথচ তাঁদের কেউ খেলার নিয়ম মানেন না। খেলার নিয়ম মানলে ভোট নিয়ে এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম ও এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।

আওয়ামী লীগের নেতারা সব সময়ই দাবি করেন, বিএনপির সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির কোনো মিল নেই। যদি না থাকত, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যা যা করেছে, আওয়ামী লীগ তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিত না। বিএনপির আমলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলেও হচ্ছে। বিএনপির আমলে বিরোধী দলের নেতাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হতো, এখনো হচ্ছে। বিএনপির আমলে বিদেশে অর্থ পাচার হতো, এখনো হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রতিশ্রুতি থাকে। বাস্তবে তার বিপরীতটাই ঘটে।

শুক্রবার দুপুরে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। জানতে চাই, পরিস্থিতি কেমন? তাঁরা বলছেন, খুলনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শুক্রবার সকাল থেকে বাস-লঞ্চ বন্ধ করার কথা থাকলেও অনেক রুটে রাত থেকেই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গত দুই দিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের অন্তত ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় শহরে বিএনপির যে নেতার বাড়িতে উঠেছিলেন, সেই বাড়ি থেকে অন্তত ১৫ জনকে আটক করা হয়। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় পরে হোটেলে উঠেন। শুক্রবার সকালে আওয়ামী লীগের কর্মীরা শহরে এক দফা মিছিল করে। বিকেলে যুবলীগ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ করে। সাধারণ মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয়নি। এদিকে বাসের পাশাপাশি লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে পাঁচটি লঞ্চ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়রার অনুপ মণ্ডল সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজকর্মী নিয়োগ পরীক্ষা দিতে রাতেই কয়রা থেকে খুলনায় এসেছিলেন। রাতে ছিলেন এক আত্মীয়ের বাসায়। পরীক্ষা দিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ঘাটে এসে দেখেন লঞ্চ বন্ধ। সবচেয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি হয়েছে বাগেরহাটে। শহরের মোড়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা বাঁশ, লাঠিসোঁটা নিয়ে টহল দেন। এমনকি বিভিন্ন গ্রামের

আসা-যাওয়ার পথেও তাঁরা চৌকি বসিয়ে সবাইকে তল্লাশি করেন। এ যেন অঘোষিত হরতাল। আগে বিরোধী দল হরতাল ডাকত। এখন সরকারি দলই হরতাল ডেকে বসে আছে।

কেবল অনুপ মণ্ডল নন। ইউনিয়ন সমাজকর্মী পরীক্ষায় তিন জেলা সদরে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার চাকরিপ্রার্থী। সকাল ১০টায় পরীক্ষা ছিল। ভোর থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তঁারা সবাই রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক, অটোরিকশাযোগে এসেছেন। কোনো যানবাহন না পেয়ে অনেকে হেঁটে আসেন। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা নারী ছিলেন, তঁারা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেকে আগের রাতে এসে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।

এই লেখা যখন শেষ করে আসছি, তখনই খবর পেলাম, খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও সব গণপরিবহন প্রায় বন্ধ। খুলনাগামী সব বাস যশোরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বাসের যাত্রীরা তো সবাই বিএনপির সমাবেশ যাবেন না। কেউ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাবেন,কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে যাবেন, কেউ কর্মস্থলে যাবেন, তঁাদের কেন আটকানো হলো? আর সরকার যখন সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, তখন দেশের যেকোনো স্থান থেকে লোক আসতে পারে।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের লোকসমাগমে উজ্জীবিত। নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, খুলনায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হবে। এরপরই সরকার ও সরকার সমর্থক নানা সংগঠন গণপরিবহন যাতে বন্ধ থাকে, সেই চেষ্টা চালাতে থাকে। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, মানুষ প্রথমে মাইক্রোবাসে করে খুলনা যাওয়ার চেষ্টা করেছে। মাইক্রোবাসকে যখন বাধা দেওয়া হয়েছে, তখন শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে তারা খুলনার পথে রওনা হয়েছে। কোনো কোনো মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী নিয়েছেন। এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই দায় কে নেবে? আর সেই ঘটনাটি সরকার এমন দিনকে সামনে রেখে ঘটাচ্ছে, যেদিন মহাসমারোহে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হবে (২২ অক্টোবর)।

বিএনপির সমাবেশ ঠেকাতে সরকার ও সরকারি দল কেন সাধারণ মানুষকে এভাবে কষ্ট দেবে?

● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com