যে উদ্দেশ্যে ইসরায়েলে এই আকস্মিক হামলা চালাল হামাস

ইসরায়েলি ট্যাংক দখলে নেওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা
ছবি: এএফপি

গাজার গেরিলা গোষ্ঠী খুব সম্ভবত ইসরায়েলকে দর-কষাকষির টেবিলে বসাতে চায়। অথবা পশ্চিম উপকূলে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, তা সফল হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

সপ্তাহান্তে ইসরায়েলের ওপর যে হামলা হলো, তার সঙ্গে ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ৫০ বছর আগে এই সময়েই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল। এই দুই হামলায় সাদৃশ্যের জায়গা হলো সৈন্যদের পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি। তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগা ইসরায়েলি সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাকে চমকে দিতে পেরেছিল।

ইয়ম কিপ্পুর একদিক থেকে আলাদাও। কারণ, ওই যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়ার সেনারা অপেক্ষাকৃত বেশি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬৭ সালে হৃত সিনাই উপত্যকা ও গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধার করা। আর এতে তাঁদের সহযোগিতা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধে হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিলেন।

অন্যদিকে হামাস একটি গেরিলা গোষ্ঠী। ২০০৭ থেকে তারা ভূমধ্যসাগর ও ইসরায়েলের মধ্যবর্তী অঞ্চল ‘গাজা’ শাসন করছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ–অধ্যুষিত এই গাজাকে বলা হয় উন্মুক্ত কারাগার। হামাস গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলি শহর ও গ্রামের ভেতর ঢুকে দ্রুততার সঙ্গে সামরিক অবকাঠামাগুলো দখল করে নেয়। তাদের আক্রমণের মুখে ইসরায়েলি সেনারা এবার রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েন।

ফিলিস্তিনি বাহিনীর এমন হামলা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু ১৯৭৩ সালের মতো এই হামলার উদ্দেশ্য কোনো অঞ্চল দখল করা বা ধরে রাখা নয়। নিঃসন্দেহে অভিযানটি আত্মঘাতী। এর উদ্দেশ্য হত্যা ও ধ্বংসসাধন। হামাস চেয়েছে ফিলিস্তিনি বন্দী ও জিম্মিদের গাজায় ফিরিয়ে নিতে। সত্তরের দশকে প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) উদ্দেশ্যও একই রকম ছিল। তবে তাদের অভিযান এত ব্যাপক ছিল না। ১৯৪৮–এর যুদ্ধে যদিও দুই হাজার আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল, তবু এ হামলা ব্যাপকতার দিক থেকে তাকে ছাড়িয়ে গেছে বলা হচ্ছে। এই মুহূর্তে গাজায় ইসরায়েলের ১০০ জিম্মি আটক আছেন।

হামাসের লক্ষ্য কী? ১৯৭৩ সালে মিসরের কিছু পরিষ্কার হিসাব-নিকাশ ছিল। সিনাই থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের যে আপসরফা হয়েছিল, ইসরায়েল পরে তা অস্বীকার করে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ভেবেছিলেন, সেনা হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তিনি শক্তির একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন এবং ইসরায়েলও আলোচনার টেবিলে বসবে। কিন্তু এর মধ্যে মিসর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব থেকে মার্কিনদের বলয়ে ঢুকে পড়ে। সাদাত ঝুঁকি নিলেন, যদিও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাঁর পক্ষে ছিল।

মনে হচ্ছে, হামাসও ইসরায়েলকে দর-কষাকষির জায়গায় আনতে চাইছে। ২০১৮ সালে হামাস নেতা ইয়াহইয়া সিনওয়ার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে হিব্রুতে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, তিনি বুঝেশুনে দীর্ঘমেয়াদি সন্ধির ঝুঁকি নিয়েছেন। কারণ, নেতানিয়াহু গাজায় চাপ কমানোর ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু তিনি হামাসের দীর্ঘমেয়াদি দাবিদাওয়া মেটাতে রাজি হননি। এই দাবিগুলোর মধ্যে ছিল, কারাবন্দীদের ফিরিয়ে দেওয়া, আন্তর্জাতিক সীমান্ত খুলে দিয়ে বেষ্টনী প্রত্যাহার করা এবং গাজায় একটি বন্দর ও বিমানবন্দর স্থাপন করা।

দীর্ঘ ১৬ বছরের আটকাবস্থা এবং দফায় দফায় বিপর্যয়মূলক যুদ্ধ, গাজার হাজার হাজার অধিবাসীর মৃত্যুর পর হামাস আশা করছিল যে তারা অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু হামাস আগেই আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। সাম্প্রতিক হামলায় বড় সংখ্যায় বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি এবং জিম্মি করার কারণে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

ইসরায়েলে চরম ডানপন্থী সরকারের অধীন কোনো আপসরফা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়তে বলেছেন। যদিও গাজা ছেড়ে তারা কোথায় যাবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে তিনি কিছু বলেননি। পাশাপাশি হামাসের ওপর উপর্যুপরি হামলার হুমকি দিয়েছেন। শত শত ফিলিস্তিনি ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন।

মন্ত্রিসভা বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বেযালেল স্মটরিচ ‘নিষ্ঠুর’ জবাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর অর্থ গাজায় যেসব ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছেন, এই বোমা হামলায় তাঁরাও প্রাণ হারাবেন। চরম ডানপন্থীদের জন্য এ ঘটনা ইসরায়েল ও পশ্চিম তীর, পশ্চিম তীর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত ফিলিস্তিনি–অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকার মধ্যে উত্তেজনা বাড়ানোর একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। নেসেটের সদস্যদের প্রত্যাশা, বড় সংখ্যায় ফিলিস্তিনিদের এবার তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এই প্রত্যাশার কথা তাঁরা জোর গলায় বলছেনও।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজা পুনর্দখল করে ক্ষমতা থেকে হামাসকে সরিয়ে দিক, এমন দাবি শুধু চরম ডানপন্থীদের নয়, ইসরায়েলের ভেতরেও এই দাবিতে অনেকে সোচ্চার। ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এই দাবি অকল্পনীয় নয়। কিন্তু গাজার পুনর্দখলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

যে অঞ্চল প্রায় ৩০ বছর আগে ইসরায়েলি সেনারা ছেড়ে এসেছেন, তা আবারও সেনা শাসনের আওতায় যাবে। অন্যদিকে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে কদিন বাদে জিম্মিদশায় থাকা ইসরায়েলিদের মুক্তির ব্যাপারে জোরালো জনমত গড়ে উঠবে। সে জন্য হামাসের সঙ্গে তাদের চুক্তি করতেই হবে। কিন্তু তার বিনিময়ে বড় সংখ্যায় বন্দিমুক্তি এবং জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে উল্লেখযোগ্য ছাড় দিতে হবে। এ ধরনের চুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম।

কোনো কোনো ভাষ্যকার মনে করেন, এই হামলায় ইরানের হাত আছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে চেষ্টা, তা ব্যর্থ করে দিতে ইরান এই কাজ করেছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা খুব গ্রহণযোগ্য নয়।

উপসাগরীয় দেশগুলোর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হামাসকে প্রতিক্রিয়া দেখানোয় উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল অনেক আগে থেকেই। কারণ, পশ্চিম উপকূলে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়ছিল, সেই সঙ্গে ছোট সম্প্রদায়গুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলার তীব্রতাও ছিল, জেরুজালেমে আল–আকসা/টেম্পল মাউন্টের ওপর যে স্থিতাবস্থা, তার নির্লজ্জ লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আরেকটি ইন্তিফাদা ঘটতে যাচ্ছে, এমন আশঙ্কা ছিলই।

গণ-অভ্যুত্থানে সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে হামাস হয়তো চেয়েছিল এই অভ্যুত্থানকে নিজেদের হাতে রাখতে। পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাস প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন। নেতৃত্বের এই শূন্যতা হয়তো হামাস পূরণ করতে চেয়েছিল। এর ফল কী হবে, তা হয়তো তারা চিন্তা করেনি।

  • ইয়ায়ের ওয়ালাক ইসরায়েলি স্টাডিজবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক এবং সোয়াস, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সেন্টার ফর জিউইশ স্টাডিজের প্রধান