‘কালুরঘাটের নতুন সেতুসহ বেশ কিছু সমস্যার কথা অতীতের কোনো সরকার তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। আমরা চাই, এই সরকার চট্টগ্রামের কিছু মৌলিক সমস্যার দিকে নজর দেবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর একজন বাসিন্দা এভাবেই তাঁর প্রত্যাশাটা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথায় চট্টগ্রামের একটি বিরাট অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের অন্তরের কথাটাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রামের সন্তান। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আরও কয়েকজন গুণী ও যোগ্য মানুষ। এখন চট্টগ্রামের মানুষ দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যাশা করে, এই নিরপেক্ষ মানুষগুলো চট্টগ্রামের জন্য সত্যিকার অর্থে প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে করবেন।
দীর্ঘদিন ধরে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও কারণে-অকারণে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি অথবা শেষ হয়নি, নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা বেশি। বিশেষ করে কালুরঘাট সেতু, কর্ণফুলী দখল ও দূষণমুক্ত করা, জলাবদ্ধতা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হবে বলে মানুষ নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে।
৯৩ বছর বয়সী জীর্ণ যান চলাচলে অযোগ্য কালুরঘাট সেতু এখন জোড়াতালি দিয়ে মেরামতের চেষ্টা চলছে। মেরামতের কাজ চলছে এক বছর ধরে। গত মার্চ মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয়নি।
এই পথে চলাচলকারী সব যানবাহন নদী পার হতে ব্যবহার করছে ফেরি। কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে ফেরির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষ আর যানবাহনের অপেক্ষার ভোগান্তি চলছে দিনের পর দিন। এই অপেক্ষা অনেক সময় ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। এই বর্ষায় বৃষ্টিতে জোয়ারের সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফেরিতে কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে ফেরিতে যেতে হয়। অনেক সময় কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফেরি বন্ধ হয়ে গেলে মালামাল নিয়ে বর্ষার প্রবল স্রোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হয়। ঘটেছে দুর্ঘটনা, হয়েছে প্রাণহানি।
কর্ণফুলী সেতু মেরামতের কাজ শেষ হলেও এসব ভোগান্তি যে কমবে, তা নয়। কারণ, সেতুটি একমুখী। এক পাড় থেকে গাড়ি চলাচল করলে অন্য পাড় থেকে গাড়ি আসা বন্ধ রাখতে হয়। ফলে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ। আবার রেল চলাচলের সময় দুই পাড় থেকে গাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুটি বারবার মেরামত করলেও জনভোগান্তি কমবে না। এ কারণে নতুন একটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণের দাবি চট্টগ্রামবাসী অনেক দিন ধরে জানিয়ে আসছে। এ অঞ্চলে অনেক জনপ্রতিনিধি এলেন আর গেলেন। কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি এই স্বপ্ন পূরণ করতে।
কালুরঘাট সেতুটি কর্ণফুলী নদীর ওপর। নদীটির অবস্থাও বড় করুণ। কয়েক দশক ধরে নদীটি দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। বলতে গেলে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, দস্যুতা ও দখলদারির কবলে পড়ে এটি এখন মৃত্যুশয্যায়। কয়েক দশক ধরে দুই তীরে লাগাতার দখলমত্ততায় নদীটি অস্বাভাবিক সংকোচনের কবলে পড়েছে।
১৯৮৫ সালে চাক্তাই খালের মোহনায় নদীর প্রশস্ততা ছিল ৯৫২.২৮ মিটার। ২০০০ সালে এটি এসে দাঁড়ায় ৯৩১.১২ মিটার। ২০০৫ সালে হয় ৭৯৩.৪৭ মিটার। ২০১৩ সালে এসে দেখা যায় ৫৮৬.৮৯ মিটার। ২০১৯ সালে রাজাখালীর মুখে নদীর প্রশস্ততা পাওয়া যায় ৪৫১.১৭ মিটার। ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর গুগল টাইমল্যাপস ম্যাপের ধারণ করা চিত্রে কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতুর নিচে রাজাখালী খালের মোহনায় কর্ণফুলীর প্রশস্ততা দেখা যায় মাত্র ৪৪৭.৩৭ মিটার।
শুধু দখলদারির কারণে এমন অস্বাভাবিক সংকোচনের শিকার হয়ে গেছে কর্ণফুলী। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উজানে হালদার মোহনা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১২ কিলোমিটার এলাকায় নদী দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মামলা হয়েছে। মামলার পর অবৈধ দখল চিহ্নিত করার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন আদালত।
জেলা প্রশাসক উভয় তীরের ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট তালিকাভুক্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের এই আদেশ নিয়ে একজন দখলদার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। এই আপিলের কারণে উচ্ছেদের কাজ আটকে থাকে আরও চার বছর।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট ওই আপিলটি খারিজ করে হাইকোর্টের আগের রায় বহাল রাখেন। এরপর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ দিনের অভিযানে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরপর অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। পরে কর্ণফুলী দখল ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় দখলের পাশাপাশি কর্ণফুলী দূষণও চলছে সমান্তরালভাবে। কারা করছে, কীভাবে কর্ণফুলী দূষিত হচ্ছে, এ নিয়ে ব্যাপক জরিপ ও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা হয়নি।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর বাঁচাতে, চট্টগ্রাম শহর ও দুই তীরের বিস্তীর্ণ জনপদ বাঁচাতে, বহু বিচিত্র উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীকে বাঁচাতে কর্ণফুলীকে দখল-দূষণমুক্ত করতে হবে। এই অতীব জরুরির কাজটির প্রয়োজনীয়তা আগে কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি।
চট্টগ্রামের নগরের জলাবদ্ধতাও এই নগরীর অন্যতম আরেকটি প্রধান সমস্যা। প্রতিবছর বর্ষায় নগর পানিতে তলিয়ে যাওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরসনে শহরজুড়ে কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে।
কিন্তু জলাবদ্ধতার আওতায় দিন দিন নতুন এলাকা যুক্ত হচ্ছে। এই আগস্ট মাসে পুরো শহর ডুবে যাওয়ার সচিত্র সংবাদ আমরা প্রথম আলোয় দেখেছি। এই জলাবদ্ধতা থেকেও মুক্তি চায় চট্টগ্রামের মানুষ।
চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল পার্কটি নিয়েও মানুষের অনেক প্রত্যাশা। একে পূর্ণাঙ্গভাবে একটি পার্কে পরিণত করে সর্বসাধারণের জন্য সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চট্টগ্রামের শহরতলীতে ডিসি পার্ক নামে একটি সুন্দর পার্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে জনসাধারণের জন্য কোনো পার্ক নেই। ডিসি হিলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের বাসভবন রয়েছে। এর জন্য পরিপূর্ণ পার্ক হিসেবে তৈরি করা যাচ্ছে না। নগরের কেন্দ্রে একমাত্র পার্ক থেকে জেলা প্রশাসকের বাসভবন অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে এটিকে একটি পরিপূর্ণ পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার দাবিও অনেক দিন ধরে উপেক্ষিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম শহরের যানজট, ফুটপাত দখল, ধুলাবালু, ময়লা-আবর্জনার অব্যবস্থাপনার উল্লেখ করতে চাই না।
কারণ, ঢাকাসহ সব বড় বড় শহর এ সমস্যায় জর্জরিত। পুরো দেশ সংস্কারে গিয়ে সব ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর সময় বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম সেই সংস্কারের আওতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বলে আমাদের আশা। আমরা শুধু আজ চট্টগ্রামের নিজস্ব দু-একটা সমস্যার কথা উল্লেখ করলাম। চট্টগ্রাম মানুষের মনের কথা, ‘আঁরার ইউনূস যহন সরকারপ্রধান অইয়ে, তহন আঁরার হথা তেঁই উনিবু। ইয়ান আঁরার আশা।’ (আমাদের ইউনূস যখন সরকারপ্রধান হলেন, তখন তিনি আমাদের কথা শুনবেন। এটাই আমাদের আশা)।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক