বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা প্রতিদিনই সড়ক আটকে নানা দাবি জানাচ্ছেন
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা প্রতিদিনই সড়ক আটকে নানা দাবি জানাচ্ছেন

মতামত

সবার ও সব দাবি কি এখনই তুলতে হবে

২১ আগস্ট সন্ধ্যা ছয়টার দিকে প্রধান উপদেষ্টা অনেক চেষ্টা করেও বাসভবন থেকে বের হতে পারেননি। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিক্ষোভরতদের সরিয়ে পথ তৈরি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

কয়েক দিন আগে বাসভবনের কাছেই এক হোটেলে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল তাঁর। বাসভবন থেকে হেঁটে গেলেও পাঁচ থেকে সাত মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবু বেশ দেরিই হয়ে যায় প্রফেসর ড. ইউনূসের। তখন বাসভবনের সামনেই ধরনায় বসেছিলেন এক দল মানুষ। তাঁরা মনে করছেন, তাঁরা এক কঠোর ‘বৈষম্যের শিকার’। তাঁদের চাকরি পাকা করে বৈষম্য থেকে মুক্তি দিতে হবে। আজকেই, এখনই।

এখনই সমাধান চাওয়া দলের মধ্যে আছেন সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারীরা, ম্যাটসের শিক্ষার্থী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরসহ কয়েকটি সরকারি সংস্থার কর্মচারী, দৈনিক চুক্তিতে নিয়োজিত কর্মী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, চুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানকারী বেসরকারি কোম্পানির কর্মী, চাকরিচ্যুত ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সকাল থেকে বিকেল বিক্ষোভ করছেন তাঁরা।

সচিবালয় থেকে শুরু করে পুলিশ ভবন, শাহবাগ—সর্বত্রই চলছে ‘এখনই চাই’ ধরনের আন্দোলন। ইতিমধ্যেই সচিবালয়ের কর্মচারীরা ৯ দফা দাবি পেশ করে সচিবালয় অচল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। তাঁরা প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজন করে প্রতিনিধি নিয়ে দুর্বার আন্দোলন জারি রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

৯ দফার মধ্যে আছে—১. ক্যাডার–বহির্ভূতদের জন্য বিভিন্ন স্তরে এক-তৃতীয়াংশ পদ অবিলম্বে সংরক্ষণ; ২. বিদ্যমান ব্যাপক বৈষম্য দূরীকরণে বিভিন্ন গ্রেডের

পদবি পরিবর্তন; ৩. ২০১৫ সালের বেতন কমিশনের সুপারিশে কতিপয় মামলা-মোকদ্দমার অজুহাতে বাদ দেওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল; ৪. বেতনকাঠামোতে স্কেল–গ্রেডের সংখ্যা হ্রাস করে ২০ থেকে ১৬টি গ্রেড করা; ৫. শতভাগ পেনশন পুনর্বহাল; ৬. গ্র্যাচুইটির হার ১: ২৩০-এর স্থলে ১: ৫০০ নির্ধারণ করা; ৭. সব ব্লক পদকে বিলুপ্ত করে সমপদমর্যাদা ও অনুরূপ স্কেলে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি; ৮. নবম জাতীয় পে–কমিশন অবিলম্বে গঠন ইত্যাদি।

১৮ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে কর্মরত নারীরা অবস্থান নেন যমুনার সামনে। তথ্য

আপা প্রকল্পে দুই হাজারের বেশি নারী কর্মরত রয়েছেন। তাঁরা সবাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত। কেবল নারীদের দিয়ে পরিচালিত এই প্রকল্প গত ৩০ জুন শেষ হয়ে গেছে। আরও এক বছর বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছিল চলে যাওয়া সরকার।

ওই দিন রাতে যমুনার সামনে চলে আসেন আন্দোলনকারী গ্রাম পুলিশের সদস্যরা। সকালে তাঁদের অবস্থান ছিল প্রেসক্লাবে। দুপুর ১২টার দিকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলেও রাতে চলে আসেন যমুনার সামনে। তাঁরা বলেন, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই অবস্থান করব।’ অস্থায়ী মাসিক চুক্তিভিত্তিক চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে এখন আন্দোলন করছেন গ্রাম পুলিশের সদস্যরা।

মাথাভারী প্রশাসনের খরচপাতি কমানোর জন্য বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুরব্বিরা আউটসোর্সিংয়ের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়েছেন আশির দশকেই। আউটসোর্সিংয়ের নৌকায় চড়ে এ দেশে এখন অনেক পাহারাদার কোম্পানি, তারা অফিস–আদালত–বাড়িতে ফ্ল্যাটে নিরাপত্তা বিক্রি করে। গজিয়ে উঠেছে নানা রকমের সেবাপ্রতিষ্ঠান, সরকারের কাজগুলো এখন তারাই করে। আমাদের দেশে পৌর প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচ্ছন্নতার কাজ করে নানা ‘ঠিকাদার কোম্পানি’র মাধ্যমে। তারা যাকে খুশি চাকরি দেয়, যখন খুশি বেতন দেয় বা দেয় না। বেতন কেটে রাখে। ছুটি দেয় না। চাকরি আছে কিন্তু ‘নো ওয়ার্ক নো পে’।

দাবির মিছিলে আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলোর অবহেলিত কর্মীরাও শামিল হয়েছেন। তাঁরা জানালেন, টেন্ডার জটিলতায় কর্মরত অনেকের চাকরি চলে যায়। আবার বছর শেষে জুন মাসে নবায়ন করার নামে কোম্পানি বিপুল টাকার ‘ঘুষ মানি’ দাবি করে। না দিলে চাকরি চলে যায়। তারপরও প্রতি মাসে বেতন পাওয়া যায় না। অনেক সময় পাঁচ থেকে ছয় মাস বা এক থেকে দুই বছরও বেতন বকেয়া থাকে।

কারও কারও কাছে কঠোর শোনালেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ঠিক কথাই বলেছেন, ‘১৬ বছর ধরে যেসব মানুষ কথা বলার সাহস করেননি, ৫৩ বছরে যাঁরা রাস্তায় নামার খুব একটা সাহস করেননি, তাঁরাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাচ্ছেন ১৬ দিনের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক। এসব মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত ছোট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাজপথে নামছেন। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করছেন।’

নেতাগোছের একজন জানালেন, যাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে পুনর্বহাল করতে হবে। ঝুঁকি ভাতা, প্রণোদনা, ঈদ বোনাস, বৈশাখী ভাতা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। সরকার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন বিল পরিশোধ করার কথা বললেও ঠিকাদারেরা টাকা হাতে হাতে দেয়। জেলা–উপজেলায় ঠিকাদারের হাত থেকে বেতন নিতে হচ্ছে। তারা সরকার নির্ধারিত বেতন না দিয়ে মনগড়া বেতন দেয়। আবার তারিখও ঠিক থাকে না।

আন্দোলন আর ঘেরাওয়ের মিছিলে আরও আছে ৪৩তম বিসিএস নন-ক্যাডারপ্রত্যাশীরা। তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘বৈষম্যবিরোধী ৪৩তম বিসিএস নন-ক্যাডার’। আছে বাংলাদেশ সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়িচালক বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। ১৯ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে আমরণ অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন চলে যাওয়া সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা। প্রায় ৭০০ জন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য সেখানে ছিলেন। তাঁরা বর্তমান আইজিপির সঙ্গে দেখা না করে নড়বেন না। শেষ পর্যন্ত বোধ হয় তাঁর দেখা মেলেনি।

রাত সাড়ে আটটার সময় ফেরার পথে দেখি ভিড় অনেকটাই হালকা।

এই তালিকা শেষ হবে না। কারও কারও কাছে কঠোর শোনালেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ঠিক কথাই বলেছেন, ‘১৬ বছর ধরে যেসব মানুষ কথা বলার সাহস করেননি, ৫৩ বছরে যাঁরা রাস্তায় নামার খুব একটা সাহস করেননি, তাঁরাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাচ্ছেন ১৬ দিনের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক। এসব মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত ছোট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাজপথে নামছেন। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করছেন।’

পরিস্থিতি যা তা দেখে কেউ ভাবতেই পারেন সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার ফাঁদ পাতা হচ্ছে না তো? গত বছরের ৬ অক্টোবর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় চলে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘এসব বিষয়ে বেশি কথা বলা হলে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব।’

বাংলাদেশের রিজার্ভ ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সেটা বলেছিলেন। বিদেশ ঘুরে আসার পর পছন্দের সাংবাদিকদের তিনি ডাকতেন। সেদিন ডেকেছিলেন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন থেকে ফেরার পর। সেই বন্দনা অনুষ্ঠানে তিনি দাওয়াতি সাংবাদিকদের নানা হাত কচলানো প্রশ্নের উত্তর দেন। সেদিন তিনি বিরক্ত হয়ে আরও বলেছিলেন, ‘সব গোছায়–গাছায় দেওয়ার পরে ইলেকশনের কথা, ভোটের কথা, অর্থনীতির কথা, পাকা পাকা কথা শুনতে হয়। আমি এটা শুনতে রাজি না।’

আমাদের মনে রাখা দরকার, চলে যাওয়া দল আর তাদের সরকার বাগানে একটা ফুলগাছ অবশিষ্ট রাখেনি। ফলে প্রাচীর ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিছু সুগন্ধ পাব, তার সম্ভাবনা নেই। ব্যবস্থা না পাল্টালে নতুন সমাজ না গড়তে পারলে, আমরা আবার গর্তে পড়ে যাব।

এরশাদ হটানোর পর আমাদের যেমন দশা

হয়েছিল। গুনে গুনে ২৪ বছর লেগেছে সেই গর্তের ঢাকনা খুলতে। এবার ঢাকনা লাগলে, তা খোলা আরও কঠিন হতে পারে।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

nayeem 5508 @gmail. com