ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করাতে আরব সরকারগুলোকে কয়েক দশক ধরে রাজি করানোর চেষ্টা করছে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৭ অক্টোবর নেতানিয়াহুর নৃশংস প্রতিক্রিয়া সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
একেবারে শুরু থেকেই নেতানিয়াহু ও হামাসের নতুন নির্বাচিত নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের দুটি অত্যন্ত স্পষ্ট কৌশল আছে। দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর নেতানিয়াহুর চারটি ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল—জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা; ফিলিস্তিন ও লেবাননের সব প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা; ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী শেষ করা এবং তার প্রতিরোধের অক্ষকে দুর্বল করা; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইসরাইলসহ অঞ্চলটিকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানো।
খুব অল্প সময়েই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে নেতানিয়াহুর জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তিনি ইসরাইলের নাগরিকদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে হামাসকে চাপ দিলে জিম্মিদের দ্রুত মুক্তি নিশ্চিত হবে। এটা ছিল নিতান্ত বাজে কথা। কারণ, অধিকাংশ জিম্মি ইসরায়েলের ফেলে দেওয়া বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে মারা গেছে। গাজায় এখনো আছে মাত্র ১০১ জন। আর জীবিত জিম্মিরা যদি ফিরে আসে তাহলে, জিম্মিদের জীবন নিয়ে একটা ডানপন্থী সরকারের ফায়দা লোটার অপরাধে নেতানিয়াহুকে লম্বা মেয়াদে কারাবাস করতে হতে পারে।
হামাসকে ধ্বংস করতে নেতানিয়াহু ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তিনি নতুন গতিতে লেবানন এবং হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছেন। হামাস এখনো গাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বারবার চেষ্টা করেছে ইসরায়েল, কিন্তু সেখানে হামাসের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য শক্তি আবির্ভূত হয়নি।
নেতানিয়াহুর চতুর্থ লক্ষ্য হলো ইসরায়েলকে মাথায় রেখে এই অঞ্চলকে পুনরায় সাজানো। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কেবল মার্কিন সাংবাদিকদেরকে জানাতে খুব পছন্দ করেন যে ‘মধ্যপন্থী সুন্নি’ আরব নেতারা ইসরায়েলের আঞ্চলিক আধিপত্যের এজেন্ডাকে কেমন করে সমর্থন করছেন। মধ্যপন্থী বলতে তাঁরা পশ্চিমাপন্থী বোঝান। তাঁদের সবই চরম রকমের একনায়ক।
কিন্তু, এখানে আবার ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ভুল করে। সেই দেশগুলোর ধনী শাসকদের মৌখিক সমর্থন আর সেই দেশগুলোর জনগণ এক কথা নয়। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে উদ্ধৃত করে তাদের দাবির সমর্থনে। কিন্তু পুরো উদ্ধৃতিটি এরকম, ‘আমার জনগণের ৭০ শতাংশ আমার চেয়ে কম বয়সী। তাদের বেশিরভাগ ফিলিস্তিন ইস্যু সম্পর্কে বেশি কিছু জানত না। নতুন সংঘাতের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো তারা এই সমস্যা নিয়ে পরিচিত হলো। এটা একটা বড় সমস্যা। আমি কি ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে চিন্তা করি? না। কিন্তু আমার জনগণ করে।’
আঞ্চলিক সংকটের সময়ে স্বৈরাচারী এই শাসকদের ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতি জনগণের ক্ষোভের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এই তাঁদের দুর্বলতম জায়গা। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ ঘোষণা করেছেন যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই তাঁরা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন। আর সেই অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা বাস্তব হবে বলে মনে হয় না।
এবার হামাস নেতা সিনওয়ারের দুটি কৌশলগত লক্ষ্যে আসা যাক। সিনওয়ারের মূল লক্ষ্য এক কথায়—দখলদারিত্বকে ইসরায়েলের জন্য আরও ব্যয়বহুল করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিরোধকে সব রকমে বাড়াতে হবে। দখলদারি কর্তৃপক্ষের দখলদারির ব্যয় বাড়িয়ে দিতে হবে। এই হচ্ছে আমাদের জনগণের মুক্তি এবং প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র উপায়।’
আরেক বক্তৃতায় ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে বাধ্য করার কথা বলে বলেছেন, ‘হয় আমরা বিশ্বের সঙ্গে মিলে তাদের এই জিনিসগুলো করতে তাদের বাধ্য করব... অথবা, আমরা এই দখলদারিত্বকে পুরো আন্তর্জাতিক ইচ্ছার সঙ্গে প্রবলভাবে বিরোধপূর্ণ করে একে বিচ্ছিন্ন করব। আর তা এমনভাবে করব, যেন তারা এই অঞ্চলে এবং সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে এক হতে না পারে।’
প্রথম বিচারে, হামাস নিশ্চিত রূপেই ইসরায়েলের দখলদারিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলতে পেরেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১,৬৬৪ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০৬ জন সৈন্য। ১৭,৮০৯ জন আহত হয়েছে। প্রায় ১৪৩,০০০ ইসরায়েলি নাগরিককে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েল থেকে টাকা বাইরে পাঠানো শুরু হয়ে গেছে। ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন মতে, ‘মে এবং জুলাইয়ের মধ্যে দেশের ব্যাংক থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে টাকা পাঠানো গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা সংঘাত শুরু হওয়ার সময় এতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না। এখন তাঁরা বেশি চিন্তিত।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে সিনওয়ারের কৌশল বেশি কাজ করছে বলে মনে হয়। সিনওয়ার বেঁচে থাকুন বা ইসরায়েলের হামলায় মারা যান, তাঁদের উদ্দেশ্যের নিজস্ব একটা অপ্রতিরোধ্য গতি আছে।
বাইডেনের দুর্বলতা বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য আগমনে উৎসাহিত হয়ে নেতানিয়াহু সম্ভবত বোকার মতো ভাবছেন যে তিনি উত্তর গাজা এবং দক্ষিণ লেবানন দখল করতে পারবেন। এই সম্ভাব্য নতুন দখলের মধ্যে পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ অংশ যে থাকবে, তা প্রায় নিশ্চিত।
কিন্তু নেতানিয়াহু গাজা, লেবানন বা পশ্চিম তীরে যা করতে পারবেন না, তা হলো, তিনি যা শুরু করেছেন, তা শেষ করা। যা অ্যারিয়েল শ্যারনকে গাজা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে বা লেবানন থেকে এহুদ বারাককে; তা গাজা ও লেবাননে নেতানিয়াহুর জন্যও প্রযোজ্য হবে। এটা সময়ের ব্যাপারমাত্র। নেতানিয়াহুর যুদ্ধ স্বল্পমেয়াদি ও কৌশলগত। সিনওয়ারের যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি। ইসরায়েলকে বুঝতে হবে যে শান্তি চাইলে দখলকৃত ভূমি তাকে ছাড়তে হবে।
নেতানিয়াহুর যুদ্ধ এক বছরের পুরোনো। গাজা, দক্ষিণ লেবাননের মতো ধ্বংসযজ্ঞ তিনি চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁর কোনো রিভার্স গিয়ার নেই। আর সিনওয়ারের যুদ্ধ মাত্র শুরু হয়েছে। কে জিতবে এই যুদ্ধে? তা নির্ভর করে নির্যাতিতদের সহনশীলতার মাত্রার ওপর। যুদ্ধের এক বছর পরে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মনোবল আরও বেড়েছে। এই লড়াই কেবলমাত্র শুরু। মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার সমীকরণ আসলেই বদলে গেছে, কিন্তু তা ইসরায়েল বা আমেরিকার অনুকূলে নয়।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক।
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন