রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ: পশ্চিমা পণ্ডিতেরা যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর যুদ্ধের ঔপনিবেশিক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলা গবেষকদের দ্রুতই থামিয়ে দেয় পশ্চিমা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক মহল। কেউ কেউ, বিশেষত স্বঘোষিত ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধীরা’ দাবি করেন, রাশিয়াকে উসকে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ইউক্রেনের প্রতিরোধকে ‘পশ্চিমা ঔপনিবেশিক’ চক্রান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন। অন্যরা রুশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে পর্যালোচনাকে যুদ্ধপন্থী, যুদ্ধংদেহী অ্যাজেন্ডা বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে সোভিয়েতোত্তর ভূখণ্ডগুলো (রাশিয়ার আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদের ভুক্তভোগী অঞ্চল) থেকে উঠে আসা গবেষকদের কাছে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া মোটেও বিস্ময়কর নয়। এর আগেও তাঁদের (সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ভূখণ্ড নিয়ে গবেষণাকারী) উপেক্ষা কিংবা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। 

রুশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত রয়ে গেছে, যেখানে ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে নিবিড় ও পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা হয়েছে। এর সঙ্গে অনেকাংশে যুক্ত পশ্চিমা গবেষক ও কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর চূড়ান্ত পতনকে দেখার ‍দৃষ্টিভঙ্গি। 

রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষের শুরু ষোড়শ শতকে। সে সময় ‍বিশাল রাজত্ব মস্কো বা মস্কোভি নিজেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি ও অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের ত্রাণকর্তা ‘তৃতীয় রোম’ হিসেবে ঘোষণা করে। রাশিয়ার ঔপনিবেশিক সেনারা পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ভূমির দিক থেকে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয় রাশিয়া। ব্রিটিশ, অস্ট্রীয়-হাঙ্গেরীয় এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের মতো এটিও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরে।

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর রুশ রাজতন্ত্র ও রুশ সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘোষণা করেন বলশেভিকরা। তবে রাশিয়ার উপনিবেশিত অঞ্চলগুলো রক্ষায় তাঁরা নির্মম লড়াইয়ে লিপ্ত হন। রুশ সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন ইউক্রেন, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের পুনর্দখল নেন তাঁরা। ত্রিশের দশকে রাশিয়ার জনগণের বিশালত্বের পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী মিথকেন্দ্রিক রুশ জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেন জোসেফ স্তালিন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে জাতিগত রুশদের প্রতিষ্ঠা করে বলশেভিক মস্কো। সে সময় রুশ ভাষাভাষী নয়—এমন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি জনঘনত্ব বাড়াতে রুশদের পাঠানো হয়, যাঁরা সেসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। 

স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর পাশাপাশি পুরো জাতিগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক স্থানান্তর এবং গণহারে প্রাণহানির পরিবেশ সৃষ্টি করার সবটাই ছিল সোভিয়েত উপনিবেশায়নের অংশ। রুশ ছাড়া অন্য ভাষাভাষী লোকজনের সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসকে তুচ্ছজ্ঞান করে রুশীকরণকে উপস্থাপন করা হয় আলোকায়ন হিসেবে। একই সময়ে রুশ সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলোর জনগণকে ভোটাধিকারের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার দেওয়ার প্রগতিশীল বার্তা প্রচারের নীতি গ্রহণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

 নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় নজর দিয়ে পশ্চিমা গবেষক মহল প্রায়ই একটি বাস্তবতা এড়িয়ে যেতেন। সেটি হলো রাশিয়ার উপনিবেশায়িত সীমান্ত রক্ষায় বিভোর ছিলেন স্তালিন। জারপন্থী রাশিয়ায় ভূখণ্ড রক্ষায় জাতিগত নিধন, ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধ্বংস এবং রুশ জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতিকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার যে অস্ত্র প্রয়োগ করা হতো, সে পথেই হেঁটেছেন তিনি। 

পশ্চিমা পণ্ডিতদের ব্যাপক নজর ছিল সোভিয়েত মহানগর মস্কো ও লেনিনগ্রাদের দিকে। সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত প্রান্তিক জনপদ নিয়ে তাঁদের জানাশোনা ছিল একেবারে কম। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তাঁদের কেউই মধ্য এশিয়া, ককেশাস কিংবা বাল্টিক অঞ্চলে আশির দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়কার অভ্যুত্থান কিংবা তাজিকিস্তান, নাগোরনো-কারাবাখ, ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, আবকাজিয়া, দক্ষিণ ওসেটিয়া ও চেচনিয়ায় রক্তপাতের বিষয়টি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারেননি। 

আশির দশকের শেষের দিকে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পঠন-পাঠন ‍শুরু করা গবেষকদের দেশের বিষয়ে জানাশোনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। তাঁরাই বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে মস্কোতে গিয়ে দীনহীন লোকজনের দেখা পান। সোভিয়েত শাসনের ভুক্তভোগী মনে হতো চরম দারিদ্র্যপীড়িত রুশদের। আর্থিক দিক দিয়ে সোভিয়েতের অধীন মস্কোকে বস্তুগত প্রাচুর্যে পূর্ণ সাম্রাজ্যভুক্ত মহানগরের চেয়ে অনেক বেশি ইউরোপের প্রান্তিক অঞ্চল বলে মনে হতো। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত 

বোতাকোজ কাসিমবেকোভা সুইজারল্যান্ডের বাসেল ইউনিভার্সিটির আধুনিক ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক