ন্যাটো-ইউক্রেন ঐক্যে ভাঙন, কিন্তু পুতিনের আশা পূরণ হচ্ছে না

ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। এ যুদ্ধের কারণে তাদের মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটাই বেড়েছে।
ছবি : রয়টার্স

বহুপ্রত্যাশিত ভাঙনের শুরুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ন্যাটোর ভিলনিয়াস সম্মেলনে সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের ঠোকাঠুকি বেশ পরিষ্কারভাবেই দৃশ্যমান হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সময়সীমা নির্ধারণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন জোটটির নেতারা। এ পরিস্থিতিকে তিনি ‘উদ্ভট’ বলেছেন।

ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিচ্ছে—এমন দুটি দেশের দিক থেকেই প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া এসেছে। এটা বিরল ঘটনা। প্রথমে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘মানুষ সামান্য কৃতজ্ঞতার প্রকাশটা দেখতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, একটা অস্ত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা অস্ত্র চাওয়া ইউক্রেনীয় নেতাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কথাতেও বেন ওয়ালেসের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার মানুষেরা কৃতজ্ঞতা প্রত্যাশা করে।’
এ প্রতিক্রিয়ায় ভলোদিমির জেলেনস্কি স্পষ্টতই ধাক্কা খান এবং বিস্মিত হন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইউক্রেন কৃতজ্ঞ।

এক বছরের বেশি সময়ের রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর এটা মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। ইউক্রেনে রাশিয়ানদের আগ্রাসনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। প্রথম ও সর্বাগ্রে ক্ষতিটা হয়েছে ইউক্রেনের। কিন্তু সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে। এ যুদ্ধের কারণে তাদের মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটাই বেড়েছে।

ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর সামনে প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনকে যে পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিচ্ছে, তাতে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের যথেষ্ট অস্ত্র থাকবে কি না অথবা ইউক্রেন যখন যা চাইবে, তখন তাদের সেটা দিতে হবে কি না। এ প্রশ্নে এবারের সম্মেলনে উদ্বেগ ও চাপ ছড়িয়ে পড়েছিল।

পশ্চিমা সামরিক জোট ও ইউক্রেনের সম্পর্কের এই ফাটলের ব্যাপার অনেক আগে থেকেই ধারণা করা গিয়েছিল। রাশিয়াও দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য ক্ষণগণনা করে এসেছে। কিন্তু মস্কো যেমন আশা করেছিল, তত বড় ভাঙন এটা নয়। প্রকৃতপক্ষে জোটের সম্প্রসারণ ও নতুনভাবে সজ্জিতকরণের প্রশ্নে ন্যাটোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।

আগ্রাসন শুরুর দিকে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল যে যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই সেটা রাশিয়ার পক্ষে যাবে। পশ্চিমা দেশগুলো শুরুতে যে সমর্থন নিয়েই এগিয়ে আসুক না কেন, সময় যত গড়িয়েছে, ততই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে দিন যত গড়াচ্ছে, যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, জনগণের সামনে তার ন্যায্যতা ব্যাখ্যা করা তাদের জন্য কঠিন হচ্ছে।

এ প্রেক্ষাপটে বড় পরিসর থেকে দেখতে গেলে বলা যায়, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় সেটা রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমের অনেক অংশে মূল্যস্ফীতি এবং একই ধরনের অর্থনৈতিক সংকট ডেকে এনেছে। দক্ষিণ বিশ্বে এ প্রভাব আরও বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে। জরিপ বলছে, ইউরোপের মানুষেরা যুদ্ধ এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু যতটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ততটা ক্লান্ত তাঁরা নন।
রাজনৈতিক সাড়া ও ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে

প্রত্যাশামাফিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছিল ন্যাটো। কিন্তু ভিলনিয়াস সম্মেলনে সে অবস্থার পরিবর্তন শুরু হলো। এই প্রথম ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নতুন একটি সমন্বিত পরিকল্পনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। হাজার হাজার পৃষ্ঠার এই শ্রেণিকৃত নথি স্বাভাবিকভাবেই গোপনীয়, কিন্তু প্রতিবেদন থেকে এই ইঙ্গিত মিলছে যে সেনা নিয়োগ, নতুন অস্ত্র ও বিনিয়োগের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এ পরিকল্পনায়।

অন্যভাবে বলা যায়, অবশেষে ন্যাটো তার সদস্যদেশগুলোকে এটা বলতে পারছে যে নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে তাদের কতটা ও কী কী খাতে ব্যয় করতে হবে। ন্যাটোকে নতুনভাবে সজ্জিতকরণ যেমন বাস্তব, তেমন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

ন্যাটো এখন নতুন সামরিক মতবাদে নিজেকে সজ্জিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সামগ্রিকভাবে ইউরোপ মহাদেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও দাঁতভাঙা জবাব দিতে সক্ষম স্থল ও আকাশযুদ্ধের প্রস্তুতির ওপর জোর দিচ্ছে ন্যাটো। ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ যুদ্ধের পুরোপুরি বিপরীত এ অবস্থান।

এর মানে, পুরো ইউরোপ মহাদেশের জন্য ন্যাটোর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেল।

ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর ক্ষেত্রে এ দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক দিক হলো, তারা পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে যে তাদের কাজটি এগিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর ক্ষেত্রে মুদ্রার অপর পিঠটা হলো, তারা এখন খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। তারা কি তাদের দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে—এ ভাবনা তারা ভাবছে।

ইউক্রেন এখন বিশাল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করছে। বেন ওয়ালেস ভিলনিয়াসে যে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তার মূল হলো, কিয়েভ ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোকে নিজেদের অস্ত্রের মজুত শূন্য করে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করছে।

এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ১৫৫ মিলিমিটার হাউটজার আর্টিলারি গোলা। ইউক্রেনকে এই গোলা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিয়েভ সেগুলো বেহিসাবির মতো খরচ করে চলেছে। ইউক্রেন দুই দিনে অথবা দশ দিনে এত গোলা পুড়িয়েছে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করতে এক মাস লেগে যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এটা ওয়াশিংটন ও কিয়েভ—এ দুই পক্ষের মধ্যেই সমস্যা তৈরি করছে।

ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর সামনে প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনকে যে পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিচ্ছে, তাতে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য তাদের যথেষ্ট অস্ত্র থাকবে কি না অথবা ইউক্রেন যখন যা চাইবে, তখন তাদের সেটা দিতে হবে কি না। এ প্রশ্নে এবারের সম্মেলনে উদ্বেগ ও চাপ ছড়িয়ে পড়েছিল।

এর কোনোটিই রাশিয়ার জন্য ভালো সংবাদ নয়; যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তিটি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন যদি তারা দ্রুতগতিতে চালিয়ে শেষ করতে পারত, তাহলে রাশিয়া নিজেদের পক্ষে নিতে পারত।

  • ফয়সল আল ইয়াফি মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ বিষয়ে অভিজ্ঞ সাংবাদিক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত