নতুন শিক্ষাক্রম এক বছর পার করল। তার আগে ২০২২ সালে কেবল ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম (পাইলটিং) চালানো হয়। এর মধ্যে ৫১টি ছিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৯টি মাদ্রাসা ও ২টি কারিগরি বিদ্যালয়।
পরীক্ষা চালানো হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়, একটি করে সেকশনে। ওই সময় নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা এর প্রশংসা করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের সেকশন বদল করে নতুন শিক্ষাক্রম নিতে চেয়েছে। এমনকি অভিভাবকদের অনেকে এ জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে দেনদরবার করেছেন।
এরপর ২০২৩ সালে সারা দেশে এ শিক্ষাক্রম চালু করা হয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে। শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন মহল থেকে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। এই একটি বছর সেসব সমালোচনার জবাব দিতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষাক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে।
সমালোচনা শুধু শিক্ষাক্রম নিয়ে ছিল না, সমালোচনা ছিল পাঠ্যবই নিয়েও। অভিযোগ ওঠে, সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে দেখানো হয়েছে, মানুষের জন্ম হয়েছে বানর থেকে। আরও অনেক অভিযোগের মধ্যে ছিল এ বইয়ে মধ্যযুগের ইতিহাস অংশে মুসলিম শাসকদের হেয় করা হয়েছে।
বিজ্ঞান বই নিয়ে অভিযোগ ওঠে কুম্ভিলকবৃত্তির। বিদেশি কোনো সাইট থেকে হুবহু তুলে দেওয়ার প্রমাণও তুলে ধরা হয়। অভিযোগ ওঠে, নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্মশিক্ষাকে গৌণ করা হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি অনেকেই বিভিন্ন বইয়ের নানা অসংগতি ও ভুল ধরিয়ে দিতে থাকেন। একপর্যায়ে এসে এনসিটিবি বাধ্য হয় সমাজ বই তুলে নিতে। বিজ্ঞান বইয়ের লেখক-সম্পাদকেরা লিখিত বিবৃতি দিয়ে তাঁদের ভুল স্বীকার করেন। এরপর এনসিটিবি উদ্যোগী হয়ে নতুন পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারে স্কুলগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া শুরু করে। শেষে বইয়ের লেখক-সম্পাদকদের একসঙ্গে বসিয়ে ভুলের তালিকা করে সেগুলো স্কুলে পাঠায়।
এ পর্যন্ত হলে কোনো সমস্যা ছিল না। এরপর শুরু হয় এই শিক্ষাক্রম নিয়ে নতুন ধরনের বিতর্ক। অভিভাবকেরা অভিযোগ করেন, এই শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে বসছে না। ফলে তাদের পড়াশোনা হচ্ছে না। তাঁরা আরও বলেন, এই শিক্ষাক্রমে দলগত কাজ বেশি। ফলে দলের প্রধান বাধ্য হয়ে কাজ করে, অন্য শিক্ষার্থীরা কিছু করে না।
আবার অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে গিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ের জন্য অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। আর স্কুল থেকে এমন সব উপকরণ দিয়ে এমন সব জিনিস বানাতে দেয়, যা জোগাড় করে বানানো কষ্টকর হয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে, শিক্ষার্থীরা ডিভাইসে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ, শিক্ষকেরা এমন কাজ দিচ্ছেন, যা করার জন্য মুঠোফোন দেখতে হয়। এরপর স্কুলে রান্না করা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। প্রশ্ন ওঠে, ডিম ভাজি করা আর আলুভর্তা করা শেখাতে স্কুলে পাঠাতে হবে কেন?
এসব অভিযোগের জবাব দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার মিডিয়ার সামনে কথা বলেছেন। শিক্ষামন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে, গাইড ব্যবসায়ী আর কোচিং ব্যবসায়ীরা এ ধরনের অপপ্রচারে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
নতুন শিক্ষাক্রম সফল করা গেলে গাইড-নোটের ব্যবসা আর প্রাইভেট-কোচিং–বাণিজ্য বন্ধ হবে, সেটা আমরা আগেও বলেছি। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য, নতুন শিক্ষাক্রমের ধারণা যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে দীর্ঘ যে ‘হোমওয়ার্ক’ করা হয়, সেটি অনেকের জানা নেই। অভিভাবকদের একটা বড় অংশ এখনো মনে করেন, পুরোনো শিক্ষাক্রমই ভালো ছিল। সেখানে অন্তত ‘বেসিক’ শিক্ষাটা পেত। আগের পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়ুক আর নোট পড়ুক, পড়াশোনার মধ্যেই থাকত। এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের শিক্ষার উদ্দেশ্য, পরীক্ষার উদ্দেশ্য—এগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া দরকার। নইলে এসব সমালোচনা বন্ধ হবে না।
বছরের শেষ দিকে আরেকটি খবর সবার চোখে পড়ে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিলনায়তনে কয়েকজন শিক্ষক আলোচনা করতে চাইলে তাতে বাধা দেওয়া হয়। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই যে সংশোধন ও উত্তরণের পথ থাকে, তা আমাদের মেনে নিতে বাধা কোথায়? এ ছাড়া একই সঙ্গে নিজেদের ঘাটতিগুলোও খুঁজে দেখা দরকার।
একেকটি পাঠ্যপুস্তকে লেখক-সম্পাদক হিসেবে ১০-১২ জনের নাম থাকে। অথচ এরপরও বইয়ে নানা অসংগতি ও ভুল থেকে যাচ্ছে। এর মানে, তাঁরা যথেষ্ট সময় দিয়ে একসঙ্গে বসে পুরো বই দেখছেন না। আর এনসিটিবির সম্পাদনা শাখারও দুর্বলতা আছে। ফলে বইগুলোতে নানা অসংগতি দেখা যায়। এ ছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণেও ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।
‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’ শ্রেণি কার্যক্রমে সুনির্দিষ্ট চারটি ধাপের কথা বলা আছে। সেটি বুঝতে না পেরে শিক্ষকেরা গতানুগতিক ধারাতেই শ্রেণিকক্ষে পড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ‘পারদর্শিতাভিত্তিক’ মূল্যায়নপদ্ধতিও তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি শিক্ষক–সহায়িকা যথাসময়ে শিক্ষকদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাঁরা ঠিকমতো এটি অনুসরণও করছেন না।
আগামী বছর আরও দুটি শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। তখন আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবক এর সঙ্গে যুক্ত হবেন। তাঁদের আস্থায় নেওয়ার জন্য যৌক্তিক অভিমতকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষাক্রমের বদল এর আগেও হয়েছে; তবে এত সমালোচনা আগে হয়নি। বড় ধরনের পরিবর্তনে বড় ধরনের আপত্তি ও মন্তব্য আসবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা মনে করি, নতুন শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। এ জন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন্তব্য ও সমালোচনাকে বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। নইলে প্রাইভেট-কোচিং আর নোট-গাইডের চক্করে আবার ঢুকে যাবে শিক্ষার্থীরা।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক