শাহবাজ শরিফ
শাহবাজ শরিফ

মতামত

শাহবাজই সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল?

পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি এম আর কায়ানি বলেছিলেন, অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনী পররাজ্য দখল করে, আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজ দেশের ভূখণ্ড দখল করে। বিচারপতি কায়ানি স্পষ্টবাদিতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর লেখা বই ‘দ্য হোল ট্রুথ’, ‘নট দ্য হোল ট্রুথ’, ‘হাফ ট্রুথ’ প্রভৃতি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

গেল শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে কায়ানি যখন হাইকোর্টের বিচারপতি, তখন আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। আইয়ুব খান তাঁর পূর্বসূরি ইস্কান্দার মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। আবার ১৯৬৯ সালে আইয়ুবকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন।

১৯৭৭ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউল হক। ১৯৮৮ সালে রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দরজা খুলে যায়; যদিও রিমোট কন্ট্রোলটি সেনাবাহিনীর হাতেই থাকে।

১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন পারভেজ মোশাররফ এবং তিনিও এক দশকের মতো দেশটি শাসন করেন। পাকিস্তানে কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। তিন সেনা শাসক তিন দশকেরও বেশি ক্ষমতা ভোগ করেছেন।

পারভেজ মোশাররফের বিদায়ের পর পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ সেনাশাসন না এলেও পেছন থেকে তাঁরা সব সময় কলকাঠি নেড়েছে, যার প্রমাণ ২০১৮ ও ২০২৪–এর নির্বাচন।

২০১৮–এর নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআইএর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এবং কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে সরকার গঠনের পেছনে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে অভিযোগ আছে।

২০২১ সালে আইএসআইয়ের প্রধান পদে কে নিয়োগ পাবেন, তা নিয়ে সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরোধ দেখা দেয় এবং তার জেরে ২০২২ সালের এপ্রিলে তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হয়।

কামার জাভেদ বাজওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, সামরিক বাহিনী অতীতের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। তাঁর এই বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

কেবল ইমরানকে ক্ষমতাচ্যূত করা নয়, তাঁকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে  প্রধান তিনটি পক্ষ। সরকার, সেনাবাহিনী ও বিরোধী দল। এর যে কোনো দুটি এক হলে তৃতীয় পক্ষ হার মানতে বাধ্য। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী শেহবাজের ওপর কার ছায়া বেশি থাকবে— বড় ভাই নওয়াজ শরিফ না সেনাবাহিনী?

ইমরানের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী মিলে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করেছে। যেদিন রাশিয়া–ইউক্রন যুদ্ধ শুরু হয়, সেদিন ইমরান খান পূর্বনির্ধারিত সফরে মস্কো ছিলেন। তাঁর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নাখোশ হওয়ার এটাও বড় কারণ।

৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেহবাজ শরিফকে বেছে নেন। অথচ পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলোচিত তিন নেতা— পিটিআইএর ইমরান খান, মুসলিম লীগ এনএর নওয়াজ শরিফ কিংবা পিপিপির বিলাওয়াল ভুট্টো ছিলেন এই পদের দাবিদার।

নির্বাচনে পিটিআইএর অনুসারীরা এককভাবে সর্বাধিক আসনে জিতলেও তাদের দলীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তাঁরা সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল নামে একটি ডানপন্থী দলে যোগ দেন এবং বিরোধী দলের নেতা হন সাবেক সেনাশাসক আইয়ুব খানের নাতি ওমর আইয়ুব খান। 

২০১ ভোট পেয়ে শেহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এটি তাঁর দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণ। ২০২২ সালে ইমরান ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর গঠিত জোট সরকারেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সে সময়ে পিপিপির বিলওয়াল ভুট্টো হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো প্রতীক দেখে ভোটাররা ভোট দেন। সেই প্রতীক কেড়ে নিয়ে নির্বাচন কমিশন পিটিআইকে নির্বাচনী মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানে ‘ভোট বিপ্লব’ হয়েছে।

ইমরান খানের দাবি, তাঁদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিপুল বিজয় পিটিআইয়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পিএমএল-এন ও পিপিপিকে বেকায়দায় ফেলে। এ অবস্থায় তাদের উদ্ধার করতে আসে সেনাবাহিনী।

নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পাকিস্তানের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সরকার গঠন করা। পিটিআই যেহেতু দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারেনি, তাঁর দৃষ্টিতে তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশ নয়।

নির্বাচনের পর তিন সপ্তাহ ধরে মুসলিম লীগ এন ও পিপিপি দফায় দফায় বৈঠক করেন কোয়ালিশন সরকারের কাঠামো ঠিক করতে। একবার ঠিক হয়েছিল মুসলিম লীগ ও পিপিপি প্রধানমন্ত্রী পদ ভাগাভাগি করে নেবে। প্রথম আড়াই বছর মুসলিম লীগ এন। শেষ আড়াই বছর পিপিপি। শেষ পর্যন্ত ভাগাভাগি তত্ত্ব কার্যকর হয়নি।

মুসলিম লীগকে প্রধানমন্ত্রী পদ দেওয়ার বিনিময়ে পিপিপি নেতা আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। ৯ মার্চ ভোট। পিপিপি শেহবাজের সরকারকে সমর্থন জানালেও নিজেরা সরকারে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় পরিষদে দেওয়া ভাষণে শাহবাজ শরিফ জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। কিন্তু সেটি পিটিআইকে বাদ দিয়ে না যুক্ত করে, স্পষ্ট নয়। তাঁকে পিটিআই ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যেকোনো একটিকে পক্ষে রাখতে হবে। একসঙ্গে দুটোকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়।

পিটিআইয়ের প্রধান গওহর খান বলেছেন, তাঁরা ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করবেন, কিন্তু পার্লামেন্ট ছাড়বেন না। সেখানে সরকারের গণবিরোধী নীতির সমালোচনা করবেন।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে  প্রধান তিনটি পক্ষ। সরকার, সেনাবাহিনী ও বিরোধী দল। এর যে কোনো দুটি এক হলে তৃতীয় পক্ষ হার মানতে বাধ্য। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী শেহবাজের ওপর কার ছায়া বেশি থাকবে— বড় ভাই নওয়াজ শরিফ না সেনাবাহিনী?

নির্বাচনের আগে নওয়াজ পাকিস্তানের আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, এমনটি আলোচনা ছিল। নির্বাচন নিয়ে ও নির্বাচনের পর নানা জল্পনা–কল্পনার পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন নওয়াজের ভাই শাহবাজ। এখানেও প্রশ্ন তৈরি হয়, নওয়াজের চেয়ে কি শাহবাজের প্রতিই বেশি আস্থা রাখল সেনাবাহিনী?

শাহবাজ শরিফ যখন জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন, তখন পিটিআইএর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাহমুদ খান আচাকজাইয়ের  বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। ২ মার্চ পিটিআইএর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে পুলিশ হামলা করে অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের নেতা ওমর আইয়ুব অভিযোগ করেছেন, তাঁর বক্তৃতা সরকারি প্রচারমাধ্যমে কাটছাঁট করে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে শেহবাজের বক্তৃতা পুরোটাই সরাসরি দেখানো হয়েছে।

মূল কথা হলো ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পাকিস্তান আবারও ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেয়েছে। নওয়াজ-শাহবাজের দল পিএমএল-এন, বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানসহ (এমকিউএম-পি) ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে সরকার গঠন করে্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গঠন করা হয়নি এই অভিযোগে নির্বাচন কমিশন পিটিআই–এর নিবন্ধন বাতিল এবং দুর্নীতির অভিযোগে ইমরান খানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে।

দলের প্রধান ইমরান খানকে জেলে রেখে পিটিআই–এর অনুসারীদের নির্বাচন করতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন থেকে পদে পদে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। তারপরও পাকিস্তানে ‘ভোট বিপ্লব’ হয়েছে।

পাকিস্তানে যখন শাহবাজ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, তখন দেশটির অর্থনীতি খুবই ভঙ্গুর। নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। বৈদেশিক ঋণের ভারে দেশটি দিশাহীন। কারাবন্দী ইমরান খান পরবর্তী কিস্তির ঋণ না দেওয়ার জন্য আইএমএফের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্যের আহবান কতটা কার্যকর হবে বলা কঠিন।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি