মোদি সরকারের অধীনে ভারতে বেকারত্বের সংকট বেড়েছে।
মোদি সরকারের অধীনে ভারতে বেকারত্বের সংকট বেড়েছে।

অতিশ্রমে শ্রান্ত ভারত, সেরে ওঠার উপায় কী

আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং (ইওয়াই) নামের একটি হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ২৬ বছর বয়সী আন্না সেবাস্টিয়ান পেরাইল। গত জুলাইয়ে হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। আন্নার মৃত্যু ভারতের চরম প্রতিযোগিতামূলক কর্মসংস্কৃতির ওপর আবার মানুষের দৃষ্টিকে আটকে দিয়েছে।

ভারতে তরুণ পেশাদারদের ওপর যে অমানুষিক কাজের চাপ রয়েছে এবং কর্মচারীদের সুস্থতার প্রতি কোম্পানিগুলোর যে আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার, তা আন্নার মৃত্যুর পর আরেক দফা বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। আন্না মারা যাওয়ার চার মাস আগে থেকে ইওয়াইতে তিনি দৈনিক ১৪ ঘণ্টা কাজ করতেন। তাঁর কোনো সাপ্তাহিক ছুটি ছিল না। সপ্তাহে সাত দিনই তাঁকে কাজে যেতে হচ্ছিল।

আন্নার মৃত্যুর পর তাঁর মা ইওয়াইকে একটি চিঠি লেখেন। হৃদয়বিদারক বর্ণনায় ভরা ওই চিঠিতে তিনি তাঁর মেয়ের ওপর ‘অসহনীয় কাজের চাপের’ কথা উল্লেখ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া চিঠিটিতে তিনি বলেছেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, কোম্পানিটি তাঁর মেয়ের অস্বাভাবিক কাজের চাপ দিয়ে যাচ্ছিল এবং এর জেরেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে ও মারা যায়।

আন্নার আগে কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল, এমন কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তাঁর মায়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্না সুস্থ ছিলেন। তিনি ব্যাডমিন্টন খেলতেন এবং কায়াকিং (বইঠা দিয়ে বিশেষ ধরনের নৌকা চালানো) করতেন। কিন্তু ইওয়াইতে কাজ করার সময় আন্না মারাত্মক উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা ও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।

আন্নার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আমাকে বলছিলেন, তাঁর মেয়ে রাতে বাড়ি ফেরার পর তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা অল্প সময় কথা বলার সুযোগ পেতেন। প্রায়ই আন্না বাড়ি ফেরার পর অফিসের ম্যানেজারের ফোন আসত। ম্যানেজার তাঁকে আরও কাজ না করে বাড়ি যাওয়ার জন্য বকাঝকা করতেন। আন্নার বাবার ভাষ্য অনুযায়ী, একবার আন্না ম্যানেজারের কথায় প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন ম্যানেজার নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো রাতেও কাজ করতে পার। আমরা সবাই তো করি।’

আন্নার বাবা বলেছেন, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে আন্না বুক আটকে আসার মতো একটা অনুভূতির কথা বলেছিল, তার নিশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল; চিকিৎসকেরা তাকে বলেছিলেন, তার যতটুকু ঘুমানো দরকার, ততটুকু ঘুমাচ্ছে না।

ভারতের অসংখ্য তরুণ-তরুণীর জন্য আন্নার গল্পটি খুবই সাধারণ ঘটনা। ভারতে কিছু অভিজাত কলেজে মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ আবেদনকারী ভর্তির সুযোগ পান এবং তাঁরা কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কর্মজীবনে সফল হতে নিজেদের প্রস্তুত করেন। ঠিকমতো না খেয়ে, না ঘুমিয়ে পরীক্ষায় পাস করার পরও এখানে ভালো বেতনের একটি চাকরি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্যও এখানে চাকরি সোনার হরিণ।

ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৯ শতাংশ। স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর যে তরুণেরা একটি চাকরি জোটাতে পারছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই বাড়িতে থাকা ভাইবোনদের ভরণপোষণে সহায়তা করতে হচ্ছে। যখন কাজের তুলনায় যোগ্য কর্মীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন কর্মসংস্কৃতি প্রচণ্ড কঠোর হয়ে যায়। ভারতের কোম্পানিগুলো এ প্রতিযোগিতাকে নিরুৎসাহিত না করে তাদের নিজেদের উৎপাদনের টার্গেট এবং সময়সীমা পূরণের ওপর জোর দিয়ে এ সংস্কৃতিকে আরও কঠোর করে তুলছে। এতে কর্মচারীদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানোটা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে এবং কর্মীদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের মধ্যকার সীমানা মুছে যাচ্ছে।

অনেকেই মনে করেন, জেনারেশন জেড বা জেন-জির পূর্ববর্তী প্রজন্ম কাজের চাপ যতটা সহ্য করতে পারত, জেন-জি ততটা সহ্য করতে পারে না। নতুন প্রজন্মের তরুণদের বিষয়ে যে সাধারণ মনোভাব গড়ে উঠেছে, সেটি আংশিকভাবে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাঁরা কোনো বিষয়ে সহকর্মীদের সাহায্য চাইতে দ্বিধা করেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে এ আশঙ্কা কাজ করে যে তাঁদের যেকোনো ধরনের অপারগতায় সহকর্মীরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন।

আত্মীয়স্বজনের বিয়ে কিংবা নিকটাত্মীয়ের শেষকৃত্যে যাওয়ার জন্য তরুণ কর্মীদের ছুটি প্রার্থনাকে খারিজ করে দেওয়া সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মানসিক চাপ ও বিমর্ষ হয়ে পড়াটা অনিবার্য হয়ে উঠছে। আন্নার মা তাঁর চিঠিতে ইওয়াই কোম্পানিকে তাদের কর্মচারীদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছেন। এর জবাবে ভারতে ইওয়াইয়ের চেয়ারম্যান রাজীব মেমানি একটি লিংকডইন পোস্টে বলেছেন, ইওয়াই সব সময় ‘একটি স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে থাকে’ এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। মেমানির এ মন্তব্য তাঁর আগের ব্যাপক সমালোচিত একটি মন্তব্যের ঠিক উল্টো অবস্থান নির্দেশ করে। তাঁর আগের একটি পোস্টে আন্নার মৃত্যুর জন্য অতিরিক্ত কাজের চাপের অভিযোগকে সন্দেহ করা হয়েছিল।

ইওয়াই অনেক আগেই তার অতিরিক্তি চাপ দিয়ে কাজ করানোর চর্চা থেকে সরে আসার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের তরুণদের মধ্যে চাকরি ধরে রাখার প্রবল চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ১২ মাসের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কর্মী কাজের চাপে চাকরি ছাড়ার কথা ভেবেছিলেন। আন্নার বাবার মতে, একই পরিস্থিতি আন্নার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। অবশ্য আন্না ওই সমীক্ষা পরিচালিত হওয়ার পর ইওয়াইতে যোগ দিয়েছিলেন।

অনেকেই মনে করেন, জেনারেশন জেড বা জেন-জির পূর্ববর্তী প্রজন্ম কাজের চাপ যতটা সহ্য করতে পারত, জেন-জি ততটা সহ্য করতে পারে না। নতুন প্রজন্মের তরুণদের বিষয়ে যে সাধারণ মনোভাব গড়ে উঠেছে, সেটি আংশিকভাবে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাঁরা কোনো বিষয়ে সহকর্মীদের সাহায্য চাইতে দ্বিধা করেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে এ আশঙ্কা কাজ করে যে তাঁদের যেকোনো ধরনের অপারগতায় সহকর্মীরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন।

জাপানি সমাজের মতো ভারতীয় সমাজও একটি অনুক্রমিক বা হায়ারার্কিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কর্তৃপক্ষের প্রতি কর্মীর শ্রদ্ধাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয়। এ ঐতিহ্য মানতে গিয়ে এখানকার কর্মীরা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অযৌক্তিক আদেশ ও দাবির বিরোধিতা করতে পারেন না।

এ সাংস্কৃতিক কারণগুলো বিবেচনায় নিয়ে ভারতে অতিরিক্ত কাজ করানোর প্রবণতা মোকাবিলায় বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে, উন্মুক্ত যোগাযোগকে উৎসাহিত করতে এবং একটি সহায়ক কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ নিয়োগকর্তারা কর্মচারী সহায়তা প্রোগ্রাম চালু করতে পারেন, যেটি মানসিক চাপ ও উদ্বেগ মোকাবিলায় কর্মীদের পরামর্শ দেবে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পরিষেবা সরবরাহ করবে।

প্রতিষ্ঠানগুলো অফিসের বাইরে দূরে কোথাও বা বাড়িতে অবস্থান করে অফিসের কাজ করার অনুমতি কিংবা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এ ছাড়া তাঁদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে কাজের সময়সূচি নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে যোগব্যায়ামের সেশন, মাইন্ডফুলনেস কর্মশালা ও ফিটনেস চ্যালেঞ্জের মতো স্বাস্থ্য কার্যক্রম আয়োজনের কথাও আলোচনা করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে খোলামেলা আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যাতে কর্মীরা তাঁদের কাজের চাপ ও মানসিক চাপ নিয়ে তাঁদের ম্যানেজারদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারেন।

যদি কোম্পানিগুলো এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে, তাহলে একটি স্বাস্থ্যকর ও অধিকতর সহায়ক কাজের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। কিন্তু চাকরিদাতারা যদি মুখেই বলেন এবং কাজের কাজ না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠবে।

কাজের পরিবেশ কেমন, সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে কোম্পানিগুলোর কথার ওপর নির্ভর করতে পারি না। এ কারণেই আন্নার মা ইওয়াইতে কাজের পরিবেশ কেমন, সে বিষয়ে তদন্ত করতে বলেছেন। এ কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রণালয় আন্নার মৃত্যুসংক্রান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে একটি তদন্ত শুরু করেছে।

আন্নার বাবা আমাকে ‘হোয়াইট-কলার’ চাকরির জন্য সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে আইন প্রবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন, যা কঠোর জরিমানা ও আইনি শাস্তি দ্বারা সমর্থিত হবে। (ভারতে ইতিমধ্যেই ব্লু-কলার কর্মীদের সুরক্ষার জন্য আইন রয়েছে, যেখানে ওভারটাইম পে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে)। আমি পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হলে প্রথম সুযোগেই এ বিষয়ে কথা বলব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।

ভারতের বদলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য একজন সম্ভাবনাময় তরুণীর মৃত্যুর ঘটনা যারপরনাই মর্মান্তিক। সবকিছু আগের মতো চলতে দিয়ে সে মর্মান্তিকতাকে আরও বাড়তে দেওয়া আমাদের মোটেও উচিত হবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

শশী থারুর ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী